বাংলাদেশে তাবলীগ জামাত নিয়ন্ত্রণ করে ১১ সদস্যের একটি শূরা পরিষদ, যার প্রধান মাওলানা জোবায়ের। এই ১১ জনের মধ্যে ৭ জন ফয়সাল বা অামির।
মাওলানা জোবায়ের এর শ্বশুর এর অাগে তাবলীগের প্রধান ছিলেন বাংলাদেশে।
তাবলীগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড.মুশফিকুর রহমান একজন ছিলেন, অার একজন ছিলেন ওয়াসিফুল ইসলাম নামে পরিচিত। ওয়াসিফ তুলনামূলক কমবয়সী ও অত্যন্ত চতুর মানুষ।
নাইন ইলেভেনের পর ড.মুশফিকুর রহমান অালকায়েদা ও তালেবানের বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে বক্তব্য দেয়া শুরু করেছিলেন যা তাবলীগের বাকি লোকদের পছন্দ হয়নি। এটা এজন্য যে, তাবলীগওয়ালাদের জন্য সকল প্রকার রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া, ব্যক্তি কিংবা মতাদর্শের বিরোধিতা করা, সোশ্যাল ওয়ার্ক করা নিষেধ। ব্যক্তিপর্যায়ে করলেও নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে এটা একেবারেই নিষেধ।
২০০১ সালের শেষদিকে উত্তরার বিখ্যাত ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বায়তুসসালাম মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম অামি। তখন একটি তাবলীগ জামাত নিয়ে মাদ্রাসার মসজিদে অাসেন মুশফিক স্যার। তিনি একদিন মাগরিবের পর (সান্ধ্যকালীন) বয়ানে উগ্রপন্থার বিপক্ষে কথা বলেছিলেন, যা অামিসহ অামার অন্যান্য ক্লাসমেটদের পছন্দ হয়নি। অামরা পরষ্পর অালোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাম, মুশফিক ইহুদিদের দালাল; কারণ তিনি জিহাদ-বিরোধী।
অত্যন্ত সুদর্শন, মেধাবী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুশফিক স্যারের ছিল একদল ভক্ত; যার বেশিরভাগই তাঁর ছাত্র। ইংরেজি, অারবি, ফ্রেঞ্চ ও উর্দু ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন মুশফিক স্যার। তাবলীগের নির্দিষ্ট সিলেবাসের বাইরে কথা বলার কারণে অতি-তাবলীগী গ্রুপ মুশফিকবিরোধী হয়ে ওঠে।
অানুমানিক ২০০১ সালে মুশফিক গ্রুপের সাথে জোবায়ের-ওয়াসিফ গ্রুপের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। তখন তাবলীগের অাভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জোবায়ের-ওয়াসিফ গ্রুপের কাছে মুশফিক গ্রুপের পরাজয় হয়; মুশফিক স্যার নেতৃত্ব পেলেন না, জোবায়েরের হাতেই নেতৃত্ব থাকলো। মাওলানা অাবুল ফাত্তাহ নামক কাকরাইলের একজন মুরুব্বিও মুশফিক স্যারের পক্ষ নেন, কিন্তু জোবায়ের-ওয়াসিফের কারণে তিনিও কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
এসময়ে ওয়াসিফের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ তোলে মুশফিক গ্রুপ। অামেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীদের দেয়া তাবলীগী ফান্ডের টাকা ওয়াসিফ লুটপাট করছে বলে প্রমাণ হাজির করতে থাকে মুশফিক গ্রুপ।
এদিকে ওয়াসিফের পক্ষ নিল জোবায়ের। জোবায়েরের নেতৃত্বের জোরালো সমর্থন করলো ওয়াসিফ, (সবাই ডাকে ওয়াসিফ ভাই বলে।) তখন দিল্লীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে নালিশ করলেন মুশফিক স্যার, কিন্তু মাওলানা সাদের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ওয়াসিফকে সমর্থন জানাল। দিল্লীর মুরুব্বিদের মধ্যেও কোন্দল শুরু হলো, তবে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকলেন সাদ, তাই এ দ্বন্দ্ব খুব মারাত্মক হয়নি দিল্লীতে।
বাংলাদেশে এ সংকট ভয়ানক হতে লাগলো দিনদিন। মুশফিক স্যারের অনুসারী ছাত্ররা টঙ্গীর ইজতেমার (এস্তেমাও বলে) মাঠে, কাকরাইল মসজিদে, মিরপুর-৬ এর তাবলীগী মসজিদে, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির মসজিদে গিয়ে গিয়ে লিফলেট বিতরণ করা শুরু করলো।
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখ বৃহস্পতিবার মাগরিবের বয়ানের সময়ে মুশফিক গ্রুপের লোকেরা কাকরাইল মসজিদে ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অর্থ-আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে লিফলেট বিতরণকালে ২৩ জন তাবলীগ কর্মীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে ওয়াসিফুলের লোকজন। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, মাগরিবের নামাযের পর ২০-৩০ জন তাবলীগ কর্মী কাকরাইল মসজিদ কমিটির আমির মাওলানা ওয়াসিফুলের বিরুদ্ধে এক পাতার একটি লিফলেট বিতরণ শুরু করে। ওই লিফলেটে ‘ওয়াসিফুলের হাত থেকে তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় মসজিদকে রক্ষার’ আহ্বান জানানো হয়। তাতে মাওলানা ওয়াসিফুলের বিরুদ্ধে ২০০ কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরা হয়।
এর অাগে ১৮ ডিসেম্বর-২০১৪ রাতে ২৪ জন তাবলীগ কর্মীকে আটক করা হয়। তারা মাগরিবের নামাযের পর মসজিদের ভেতরে মসজিদের আমির ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিফলেট বিলি করছিলো বলে অভিযোগ করা হয়। ওয়াসিফুলের লোকজনই তাদের মসজিদের ভেতর আটকে রাখে। এশার নামাজের পর রমনা থানায় খবর দিলে পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে যায়। [তথ্যসূত্র: al-ihsan.net, ২৬/১২/১৪]
ওয়াসিফ এর বিষয়ে অধ্যাপক মুশফিক স্যার বলেছেন,
‘ওয়াসিফ তাবলীগের সঙ্গে রাজনীতিকে যুক্ত করার প্রচেষ্টায় রয়েছে। সে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে স্বনামে হেফাজতকে সমর্থন দিয়ে লিখেছে। তাবলীগের মধ্যে থাকলে রাজনীতি নিয়ে কথা শুধু নয় আগ্রহ থাকার সুযোগ নেই। ওয়াসিফ শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বী হয়ে রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট হেফাজতকে নিয়ে পত্রিকায় লিখেছে, যা অগ্রহণযোগ্য। সামাজিক যোগাযোগ সাইটেও প্রচার করছে। অন্যদিকে সে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। দুটি বিষয় তাবলীগের জন্য হুমকি। আমি মনে করি, এর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ওয়াসিফ ও তার ছেলেদের আর্থিক হিসাব নিলেই প্রমাণ মিলবে।’
মুশফিক অারো বলেছেন,
‘যদি কেউ ওয়াসিফের কাছে হিসাব চায় তাহলেই সে তার বিরাগভাজন হবে। তার ছেলেরা কীভাবে (ঢাকার খিলগাঁওয়ে অবস্থিত) খিদমাহ হাসপাতালের পরিচালক হয়েছে, ওয়ানকার ট্রেডিং, ওয়ান এডুকেয়ারের মালিক হয়েছে। ওয়াসিফ তাবলীগের সুনাম নষ্ট করছে। ২০১৩ সালের শেষ দিকে মাওলানা আশরাফ আলীকে টঙ্গী ময়দানে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে মারধর করে ওয়াসিফ গ্রুপ। আর কাকরাইলে মেহেদি হাসান নামে একজন তাবলীগীকে মারধর করেছে। এ কারণে রমনা থানায় ওয়াসিফ, তার ছেলে ওসামার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে মেহেদি হাসান।’
[তথ্যসূত্র: al-ihsan.net, ২৬/১২/১৪]
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এর মানিকদী এলাকায় মুশফিক স্যারের অনেক ছাত্র অাছে যারা স্যারের জন্য জান ফিদা, এরা মানিকদীতে বিরাট একটি ‘স্যার সমর্থক তাবলীগ গ্রুপ’ তৈরি করলো, তবে এরা নিজেদেরকে অাসল তাবলীগী ও ‘দুর্নীতিবিরোধী তাবলীগী‘ বলতো।
অামার সাবেক কর্মস্থল (অাল-অামিন জামে মসজিদ ও মাদ্রাসা কমপ্লেক্স, পশ্চিম মানিকদী, ঢাকা ক্যান্ট.১২০৬) এ তারা অাসতে চেয়ে স্থানীয় তাবলীগীদের প্রচন্ড বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিল। মানিকদী বাজার মসজিদ-এ (অাবদুল জব্বার জামে মসজিদ বা মানিকদী কেন্দ্রীয় মসজিদ) মুশফিক গ্রুপের ভালো দাপট অাছে।
মানিকদীতে মুশফিকী তাবলীগের নেতৃত্ব দেয় অাতিক ভাই, শিবলী ও মরহুম (মৃত) বাশার চেয়ারম্যানের ছেলে। এদের সাথে অাছে মানিকদী বাজার মসজিদের মোতোয়াল্লির ছেলে বাদল। এরা সবাই মুশফিক স্যারের অন্ধ ভক্ত, এরা শুধু স্যার বলে, স্যার মানেই মুশফিক স্যার। ইতিমধ্যে জোবায়েরের সাথেও মুশফিকের দ্বন্দ্ব শুরু হয়, দ্বন্দ্ব হয়ে যায় ত্রিমুখী; জোবায়ের-ওয়াসিফ-মুশফিক গ্যাং। ২০১৫ সালে মুশফিক স্যার রংপুরের একটি মসজিদে মারা গেলে মুশফিক গ্রুপ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এরপর ক্রমশ দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে জোবায়েরের সাথে ওয়াসিফের। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের কাছে জোবায়ের প্রচণ্ড জনপ্রিয়, অার ওয়াসিফ জনপ্রিয় সরকারি অামলা, ইন্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী ও ডাক্তার তাবলীগীদের কাছে। এ দ্বন্দ্ব প্রকট হলে কাকরাইল মসজিদে বারবার সংঘর্ষ হয় দু’গ্রুপের মধ্যে। সংঘর্ষে কওমির ছাত্র বা হেফাজতীরা একচেটিয়া জোবায়েরের পক্ষে এবং কলেজ-ভার্সিটির স্টুডেন্টরা ওয়াসিফের পক্ষ নেয়।
১৪-১১-১৭ তারিখে তাবলীগের দুই গ্রুপ তাদের বাংলাদেশের মারকাজ রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে বেলা ১২টার দিকে মতবিরোধের জের ধরে দু’ দলে বিভক্ত হয়ে কথা কাটাকাটি, হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কি ও ভাংচুর করেছে! এদিন সকালে কাকরাইল মসজিদে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাবলীগের শীর্ষ নেতাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। এতে সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সৈয়দ ওয়াসিফ ইসলামসহ বেশ কয়েকজন মুরুব্বীর কক্ষের জানালা ভাংচুর করা হয় !
তথ্যসূত্র : আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম।
বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে মাওলানা সাদ বরাবরই ওয়াসিফের পক্ষে, একারণে হেফাজতপন্থী মাওলানা জোবায়ের সাদের উপর নারাজ। অথচ ওয়াসিফ হেফাজতের সপক্ষে ডেইলি স্টার পত্রিকায় লিখেছিল হেফাজতীদের মন পাওয়ার জন্য! হেফাজত বরাবরই জোবায়েরের পক্ষে।
মাওলানা সাদের সাথে নেতৃত্ব নিয়ে দিল্লীর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের দ্বন্দ্বও বেশ পুরনো। এ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে অাসে সাদের অনুসারীরা সাদকে ‘বিশ্ব তাবলীগের অামির’ ঘোষণা করলে।
পাকিস্তান তাবলীগের সাথেও মাওলানা সাদের দ্বন্দ্ব পুরনো। মাওলানা তারিক জামিলের সাথে সাদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিগত মতপার্থক্য অনেক। অাগে তাবলীগ জামাত ছিল সম্পূর্ণ দল ও রাজনীতিমুক্ত, কিন্তু এখন সেখানে হেফাজতের প্রভাব খুবই স্পষ্ট।
নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও অর্থলিপ্সার কারণে জোবায়ের এবং ওয়াসিফ গ্রুপ হেফাজত তোষণ করেছে, কিন্তু মুশফিক ছিলেন হেফাজতবিরোধী।
ওয়াসিফ কিছুটা হেফাজত-তোষণ করলেও হাতে রাখতে পারেনি, বরং কওমি মাদ্রাসার সব হুজুররা নিরঙ্কুশভাবে জোবায়েরকে সমর্থন করে যাচ্ছে সর্বদা।
নিজের নেতৃত্ব পাকাপোক্ত করতে মাওলানা জোবায়ের তাবলীগের ভেতরে কওমি মাদ্রাসার হুজুরদেরকে ঢোকালেন।
ক্রমেই অাহমদ শফি, মুফতি ফয়জুল্লাহ (হেফাজত মহাসচিব), অাল্লামা অাশরাফ অালি (মালিবাগ মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস), নূর হোসাইন কাসেমি (নায়েবে অামির-হেফাজত), মাহুফুজুল হক (রহমানিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল) সহ শীর্ষ হেফাজতীরা তাবলীগের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মিডিয়ার সাথে কথা বলা শুরু করে; যা তাবলীগে কোনোকালেই ছিলনা।
এদিকে ওয়াসিফ সুসম্পর্ক রাখে মাওলানা সাদের সাথে। তার সাথে হেফাজতের দূরত্ব বাড়ছিল ক্রমশ। ভারতের তাবলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের একই সময়ে দেওবন্দ পর্যন্ত গড়ায়। মূলত ভারত এবং বাংলাদেশ এর এই দ্বন্দ্ব কাকরাইল-হাটহাজারী এবং নিজামুদ্দীন-দেওবন্দ সম্পর্কের সাথে বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে অাছে।
পাকিস্তানেও তারিক জামিলের সাথে কওমির অালেম বিচারপতি তকী উসমানীর দ্বন্দ্ব রয়েছে, তবে সেটা এত মারাত্মক নয়।
বাংলাদেশে তাবলীগ ও হেফাজতের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন মাওলানা অানিসুর রহমান, মুহতামিম – বাবুস সালাম মাদ্রাসা, এয়ারপোর্ট ঢাকা। তাবলীগ ও হেফাজতের বলয়ের বাইরের অালেম মুফতি মাহমুদুল হাসানও (গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব ও যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মুহতামিম) এখন তাবলীগে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। অার তাবলীগ-হেফাজত-ভাস্কর্য ভাঙ্গা সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক কর্মের বিভিন্ন গ্রুপের সমন্বয়ক মাওলানা অানিসুর রহমান।
অারো একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য: তাবলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে অালেমদের সাথে ডাক্তার-ইন্জিনিয়ার তাবলীগীদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ডাক্তার-ইন্জিনিয়াররা হেফাজত বিরোধী এবং ওয়াসিফপন্থী, অার অন্যরা জোবায়েরপন্থী। তবে সবকিছুর সাথে জড়িত প্রচুরক টাকার লেনদেন। কাকরাইল মসজিদ সংলগ্ন মার্কেট, এস্তেমার মাঠ সংলগ্ন মার্কেট, এস্তেমা ও জোড় এর শামিয়ানা, তাঁবু, টিন, বাঁশ, লাইটিং ইত্যাদি বিষয়ের সাথে জড়িয়ে অাছে কোটি কোটি টাকার কারবার। এর পাশাপাশি বিদেশী মেহমানদের মেহমানদারি, ঘনঘন বিদেশ সফর, হাদিয়া-তোহফার টাকা, মসজিদ নির্মাণের টাকা নিয়েও বেশ বিরাট লোভনীয় কারবার রয়েছে। এসব টাকার একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়েই চলছে জোবায়ের-ওয়াসিফ দ্বন্দ্বের রেশ।
উভয়েই দুর্নীতিবাজ, কিন্তু ওয়াসিফ একসময় জোবায়েরের পক্ষ নিয়েছিল মুশফিককে হটানোর স্বার্থে। এজন্য মুশফিকের মৃত্যুর পর জোবায়ের এবং ওয়াসিফ প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়ায়।
সম্ভবত হেফাজত চাইছে তাবলীগের বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নির্বাচনের পূর্বে সরকারকে চাপে রাখা। নেক্সট ইলেকশনে যাতে অা.লীগ এবং বিএনপি পাল্লাপাল্লি করে ইসলামের খেদমত করার ইশতেহার দেয়, সেজন্য একটা শক্তি দেখিয়ে দিল সবাইকে। অার এই দ্বিধাবিভক্ত তাবলীগের ভোটও দ্বিধাবিভক্ত হবে, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
মুশফিক গ্রুপের ভোট এবং ওয়াসিফ গ্রুপের ভোট সরকার পেতে পারে, জোবায়ের গ্রুপের ভোট এখন হেফাজতী ভোটব্যাংক। মুশফিক গ্রুপ এখন শক্তিশালী নেই। এখন নেতৃত্বে অাছেন সম্ভবত মাওলানা মাহবুবুর রহমান। এই দ্বন্দ্বে ভারত-বিরোধিতার মেসেজ দিচ্ছে কিনা হেফাজত, তা স্পষ্ট নয়।
পাকিস্তানী তাবলীগ নেতৃবৃন্দ চুপ, মালয়েশিয়ার তাবলীগী নেতৃবৃন্দ সাদের পক্ষে। ফ্রান্সের তাবলীগ জামাত ইউরোপের মধ্যে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। সেখানে অালজেরিয়া ও মরক্কোর অভিবাসী মুসলিমরা তাবলীগ নিয়ে সারা বিশ্বে সফর করছে। ফ্রান্স তাবলীগে মুশফিক স্যারের বেশ প্রভাব ছিল। মুশফিকের পরিবারের সদস্যরা ফ্রান্সে থাকে। মুশফিক স্যার বছরে কয়েকবার ফ্রান্সে যেতেন, এবং সেখানকার তাবলীগ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
তাবলীগের সাদকে নিয়ে দ্বন্দ্বের সূচনা সম্পর্কে জানতে নিচের খবরটি পড়লেই চলবে:
নয়া দিগন্ত –
কাকরাইল মারকাজ মসজিদে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ: তাবলিগ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ
খালিদ সাইফুল্লাহ ১৫ নভেম্বর ২০১৭,বুধবার
‘‘তাবলিগের নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। ভারত থেকে শুরু হওয়া এ দ্বন্দ্ব বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ভারতের নিজামুদ্দিনের অন্যতম শূরা সদস্য মাওলানা সাদ কান্ধলভির একক নেতৃত্ব দাবি ও আকিদাবিরোধী কার্যকলাপের কারণে এ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি ঢাকার কাকরাইলে মসজিদ নির্মাণের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে দ্বন্দ্ব আরো বেড়েছে। এ জন্য বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমরা আগামী জানুয়ারিতে টঙ্গীর ইজতেমায় মাওলানা সাদ কান্ধলভি যাতে আসতে না পারেন সে জন্য আগে থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছেন। এ ব্যাপারে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনার পাশাপাশি সরকারের সাথেও বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া আগামী নভেম্বর বা ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তাবলিগের পাঁচ সদস্যের একটি টিম ভারত সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দিকে গতকালও কাকরাইল মসজিদে মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম ও মাওলানা জুবায়ের আহমদ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছে।
জানা যায়, আগামী ১৭ নভেম্বর শুক্রবার টঙ্গীতে তাবলিগের পাঁচ দিনব্যাপী জোড় শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এ জোড়ের প্রস্তুতি নিয়ে গতকাল দুপুরে কাকরাইল মারকাজে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকের আলোচনার একপর্যায়ে আসন্ন জোড়ে নারায়ণগঞ্জ জেলাকে না রাখায় প্রতিবাদ জানান মাওলানা জুবায়ের আহমদ। এ নিয়ে তখন বাগি¦তণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে ওয়াসিফুল ইসলামের অনুসারীরা জুবায়ের আহমদ সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। তখন দুই গ্রুপে সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। রমনা থানার ওসি কাজী মইনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মতবিরোধের জের ধরে তাবলিগের দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। পরিন্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। এ দিকে সংঘর্ষের পর তাবলিগের দুই গ্রুপের মুরব্বিদের নিয়ে বৈঠক করে পুলিশ। ওই বৈঠকে দুই গ্রুপ আর কোনো সংঘর্ষে জড়াবে না বলে মুচলেকা দেয়।
দেওবন্দে দিক্ষা নেয়া মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভি ১৯২৬ সালে অবিভক্ত ভারতে তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তার ছেলে মাওলানা ইউসুফ, পরে তাদের পরিবারের সদস্য মাওলানা এনামুল হাসান এ তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এনামুল হাসানের মৃত্যুর পর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য একক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি না থাকায় শূরা সদস্যদের মাধ্যমে তাবলিগ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই শূরা সভায় ভারত ছাড়াও পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন। মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভির বংশধর মাওলানা সাদ কান্ধলভিও ওই শূরার সদস্য রয়েছেন। তবে গত কয়েক বছর আগে থেকে তিনি নিজেকে আবার তার পরিবারের পূর্বসূরিদের মতো একক ইমাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে শূরা সদস্যদের মধ্যে দেখা দেয় মতভেদ। এ ছাড়া মাওলানা সাদ কান্ধলভি ইসলামি আকিদাবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য ও কার্যকলাপ করছেন বলে শূরা সদস্যরা অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাবলিগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শূরা সদস্য মাওলানা ইবরাহিম দেওনা, মাওলানা ইয়াকুব ও মাওলানা আহমদ লাট মাওলানা সাদ কান্দ্বলভীর তাবলিগ গ্রুপ থেকে বের হয়ে যান। এতে ভারতে সৃষ্টি হওয়া বিভক্তি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি শূরা কমিটি রয়েছে। এদের মধ্যে মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলামসহ কয়েকজন মাওলানা সাদের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখলেও মাওলানা জুবায়ের আহমদসহ কয়েকজন তার একক নেতৃত্ব মানতে রাজি নন। এতে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। কয়েক বছর ধরে চলে আসা এ দ্বন্দের জেরে গত বছর ভারতের মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমায় আসা ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। এ জন্য তাকে দিল্লির বিমানে ওঠার পরও প্রশাসন নামিয়ে দেয়। পরে অবশ্য কলকাতা বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসতে সক্ষম হন তিনি। এ কারণে গত বছরের টঙ্গী ইজতেমার প্রথম পর্বে তিনি বক্তব্য রাখতে পারেননি। তবে দ্বিতীয় পর্বে তিনি বক্তব্য রাখেন।
এ জন্য এ বছর আগে থেকেই মাওলানা সাদকে ঠেকাতে তৎপর হয়ে উঠেছে এ দেশের তাবলিগের মুরব্বিরা। গত ২৯ অক্টোবর দেশের তাবলিগ জামায়াতের কয়েকজন আলেম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তার ধানমন্ডির কার্যালয়ে বৈঠকে মিলিত হন। ওই সভার পর গত ১২ নভেম্বর উত্তরার একটি মসজিদে তারা বৈঠকে বসেন। ওই সভায় হেফাজত ইসলামের নায়েবে আমির আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক, মাওলানা আবদুল কুদ্দস, মাওলানা সাজিদুর রহমান, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ আহমদ শফীর উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও অসুস্থ থাকায় তার পক্ষে ছেলে মাওলানা আনাস লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। সেখানে তারা হুঁশিয়ারি জানান, দেওবন্দের অনুমোদন ছাড়া মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হবে না। তা ছাড়া ভারতের নিজামুদ্দিন থেকে যেসব মুরব্বি বের হয়ে গেছেন তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। আর ভারতের বিভক্তি দেশে টেনে না আনারও আহ্বান জানানো হয় ওই সভায়। এ ব্যাপারে পাঁচ সদস্যের একটি টিমের ভারত সফরেরও সিদ্ধান্ত নেয় হয়। টিমের সদস্যরা হলেন, তাবলীগের মুরব্বি মাওলানা জুবায়ের আহমদ ও মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, জমিয়তের উলামায়ে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক। তবে আরেক জনের নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ দিকে এ ব্যাপারে আগামীকাল ১৬ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় আবার তাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, ভারতের নিজামুদ্দিনের তাবলিগের মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভির আকিদা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি ইসলামবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। এ কারণে তাবলিগের অনেক মুরব্বি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের কাকরাইলে তাবলিগ জামাতের মুরব্বি মাওলানা জুবায়ের আহমদ এবং মাওলানা ওয়াসিফুর রহমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। মাওলানা ওয়াসিফুর রহমান ভারতের মাওলানা সাদের পক্ষ নিলেও মাওলানা জুবায়ের তার ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। এ কারণে কয়েক বছর ধরে দ্বন্দ্ব চলছে। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশে কোনো দ্বন্দ্ব চাই না। এ জন্য মাওলানা সাদ যাতে বাংলাদেশে না আসেন সে ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, মাওলানা সাদ আকিদাবিরোধী কার্যকলাপ করছেন। এ কারণে তাকে এ দেশে আমরা গ্রহণ করতে পারি না। কিন্তু আমরা ভারতের মাওলানা সাদকে যেহেতু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, সে জন্য দেশের মসজিদে মসজিদে যাতে কোনো বিভক্তি দেখা না দেয় সে চেষ্টা করছি।
এ ব্যাপারে কাকরাইল মারকাজের ওয়াসিফুর রহমানের সমর্থক মুরুব্বি অধ্যাপক মোশাররফ হোসাইন নয়া দিগন্তকে বলেন, মাওলানা সাদ তার আমলের মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন। কিন্তু ইহুদি-নাসারদের দোসররা তাবলিগের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু তারা সফল হবে না।
ওয়াসিফুর রহমানের আরেক সমর্থক মুরুব্বি জাফর আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, মাওলানা সাদ যেমন ঈমানের দিক থেকে বড় তেমনি অর্থের দিক থেকেও বড়। তার অনেকের সাথে যোগাযোগ আছে। তাকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না।’’
পুনশ্চ: হেফাজত ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা হেফাজতের জনবল, অার ধনী ব্যবসায়ীরা তাদের অর্থবল। সুফীবাদী, তুলনামূলক শান্তিপ্রিয় কওমির অালেম, মুক্তচিন্তক এবং তাবলীগের দলছুট অংশকে কাজে লাগিয়ে অাওয়ামীলীগ তাদের ভোটব্যাংক সমৃদ্ধ করতে পারে; মৌলবাদীদের সমর্থন প্রয়োজন নেই।