ইউরোপের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিপ্লব কি ঔপনিবেশিক শোষণ ছাড়া কিছুতেই হতে পারত না?

8 মতামত পাওয়া গেছে

ভাল লেখা। ধন্যবাদ।
//এখন, ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভারত দখল হবার আগে পর্যন্ত ইংরেজরা এ দেশে শুধুই ব্যবসা করেছে, সেখানে গা জোয়ারির প্রশ্ন ওঠে না ।//
আর্ধেক বললেন কিন্তু। ইংরেজরা আসার আগে, ১৭৫৭-র আড়াইশ বছর আগে থেকে পর্তুগিজ আর অন্যরাও গা জোয়ারি করেছে, সেটা হিসেবের খাতায় বাদ দেবার কারণ নেই। তবে পর্তুগিজরা এত লুটেপুটেও তেমন ফায়দা করতে পারেনি, এমন যুক্তি দিলে, ইংলিশ প্রাইভেটিয়ারদের কথাখান ভাববেন একটু। স্প্যানিশরা যা লুটপাট করত তার ওপর বাটপাড়ি করত ইংরেজরা। এই ধরুন রাণী এলিজাবেথ ১ এর আশির্বাদধন্য স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক। তিনি মূলত অতলান্তিকের পারে স্প্যানিশদের জাহাজ লুটতেন, কিন্তু ১৫৮৭-তে স্যান ফেলিপ বলে একখানি পর্তুগিজ জাহাজ তিনি লুটলেন, ব্যাস, গোয়া থেকে আনা সোনায় ভর্তি।
এরপরেও বলবেন, ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভারত দখল হবার আগে পর্যন্ত ইংরেজরা এ দেশে শুধুই ব্যবসা করেছে, সেখানে গা জোয়ারির প্রশ্ন ওঠে না?

//এমন কি হতে পারেনা যে, হাজার সালের আগের পতনটা আকস্মিক, আর হাজার সাল থেকে এই যে অনবরত মসৃণ পতন, তার পেছনে বাস্তবিকই প্রথমে মুসলমান ও পরে ব্রিটিশদের লুণ্ঠনই দায়ী ? ব্যাপারটা এমন নয় তো যে, ‘ওরা’ এগিয়েছে আমাদের শোষণ করেই, তাই ওরা হয়েছে বড়লোক আর আমরা ক্রমেই হয়েছি গরিব ? সারণিটি (চিত্র-২) খুঁটিয়ে দেখলে সে প্রশ্নেরও অনেকটাই উত্তর পাওয়া যাবে — দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ স্তম্ভগুলোতে একটু নজর দেবেন । ভাল করে ভেবে দেখুন, আমাদের শোষণ করাটাই যদি অন্যদের উন্নতির একমাত্র কারণ হত, তাহলে ওরা বড়লোক হবার সাথে সাথে আমরা সমান তালে গরিব হতাম । অথচ স্পষ্টতই ঘটনা তা নয়, কারণ ওই সময়ে ক্রমাগতই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটেছে, খুব ধীর লয়ে হলেও । ওই সময়কালে উৎপাদনের মোদ্দা অর্থমূল্য (স্তম্ভ-২), মাথাপিছু আয় (স্তম্ভ-৩) এবং জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার (স্তম্ভ-৪) — এই তিনটি হিসেবেই ক্রমাগত সমৃদ্ধি ঘটেছে, নিজেদের অতীতের তুলনায় অন্তত আমরা গরিব হয়ে পড়িনি । প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যরা তবে সমৃদ্ধ হল কীভাবে ?//

উঁহু স্যার, ঠিক যুক্তি হলনাকো।
//ব্যাপারটা এমন নয় তো যে, ‘ওরা’ এগিয়েছে আমাদের শোষণ করেই, তাই ওরা হয়েছে বড়লোক আর আমরা ক্রমেই হয়েছি গরিব ?// কেন? ওরা আমাদের শোষণ করলেই আমাদের গরীব হয়ে যেতে হবে ক্রমাগত, এমন কে বলল?
১৫০০ সাল থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ভারতে মাথাপিছু আয় বেড়েছে খুব আস্তে আস্তে, জিডিপি-অ বেড়েছে কম হারে। বাকি পৃথিবীর জিডিপি বেড়েছে তুলনায় দ্রুত। ফলে বিশ্বে ভারতের জিডিপি-র অংশ কমেছে (অবশ্য ম্যাডিসনের ক্যালকুলেশন নিয়ে প্রশ্ন না করলে)। এটা কিছু রকেট সায়েন্স নয়। এর থেকে অন্য দেশ দ্বারা ভারতের ওপর শোষণ (ইয়ে, লুণ্ঠন বললে, খুব আপত্তি করবেন?) ছিল বা ছিল না এমনটা প্রমাণ করলেন কোন যুক্তিতে? আপনার মাইনের ইনক্রিমেন্ট হচ্ছে, আর আপনার কাছ থেকে ছিনতাই হচ্ছে নিয়মিত, আপনাকে গরীবতর হতেই হবে? যদি আপনার মাইনে ছিনতাইয়ের চেয়ে একটু বেশি হারে বাড়ে তো আপনার সামান্য উন্নতি হবে, কিন্তু ছিনতাইকারীরা আপনার চাইতে দ্রুত উন্নতি করবে, কেন না তাদের মাইনে বাড়ছে, প্লাস আপনার মাইনের একটা অংশ তাদের হাতে যাচ্ছে, সেটা দিয়ে পুলিশকে ঘুঁষ দিচ্ছে, আরও বেশি করে আপনার ওপর জোর করে আপনাকে ওভারটাইম করিয়ে আরও বেশি নিচ্ছে আপনার কাছ থেকে, কিন্তু আপনি গরীরতর হচ্ছেন না । এমন হতে পারে বিশ্বাস না হলে প্রোমোটার আর সিন্ডিকেটদের দেখুন।
//আমাদের শোষণ করাটাই যদি অন্যদের উন্নতির একমাত্র কারণ হত// — আরে আরে, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্রে অমন ব্যথা করবেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে “ইহার একমাত্র কারণ হইল উহা” বলবার দিন বহুদিন চলে গেছে। কেউ বলেনি আমাদের শোষণ করাটা অন্যদের উন্নতির একমাত্র কারণ। ঐ যে সিন্ডিকেট, তাদের উন্নতির কারণ কেবল প্রমোটারদের শোষণ করা, এমন নয়। (প্রমোটাররা খদ্দেরের কাছ থেকে পয়সা তুলে নেবে কিনা, কতটা নিতে পারবে, সেটা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাবেন না, প্লিজ)। কত রাস্তা আছে।ভোটে বোমা জোগানো, ভয় দেখানো, প্রভাব খাটিয়ে কন্ট্রাক্ট আদায়। ওসব করলেই কি আপনি বলবেন, প্রমোটারদের শোষণ করা পয়সাটা নেহাত শূন্য? ছিনতাইবাজ অন্যত্র খেটে খেলে, বা ডাকাতি করলে, আপনার ওপর ছিনতাই হয়নি?

//অনেকেই, এই রকম ‘কলোনিয়াল ড্রেন’ বা ঔপনিবেশিক সম্পদ-ক্ষরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন । অবশ্য, এই সম্পদের সবটাই পাচার হওয়া সম্ভব হত না, তার একটা বড় অংশ এখানেই লেগে যেত ঔপনিবেশিক পরিকাঠামো তৈরি ও যুদ্ধবিগ্রহে । //
ঔপনিবেশিক পরিকাঠামো তৈরি কথাটার মানে হল, আরও বেশি করে কীভাবে উপনিবেশ থেকে মাল হাতানো যায়। তা উপনিবেশ-ব্যবসার একটা ইনভেস্টমেন্ট। সেটাকে ‘কলোনিয়াল ড্রেন’-র থেকে আলাদা করে দেখা যেত যদি তা উপনিবেশের লোকেদের সাহায্য করত। কিন্তু তা সাহায্য করত মাল-হাতানেওয়ালাদেরই কেবল। যেমন রেলওয়ে। আর পরিকাঠামো তৈরির চেয়েও সহজভাবে বোঝা যায় যুদ্ধবিগ্রহে। যেখানে গোরা সৈনিকের বদলে গোর্খা সৈনিক দিয়ে সস্তায় পররাজ্যগ্রাস করা যায়। পররাজ্যগ্রাস করার পর আবার ইংরেজরা বিজিত রাজ্যের ওপর রিপারেশনের বোঝা চাপিয়ে দিত। এমনকি পররাজ্যগ্রাসের সময়ই যুদ্ধ চালানোর খরচ নেওয়া হতো, যেমন পলাশির পর নবাব তৈরির খেলার দাম দিত হোনেওয়ালা নবাবরা। এটা শুধু ড্রেন নয়, ড্রেন তৈরি করার সারচার্জও।

//এই যে এত বিচিত্র সব সম্ভাব্য কারণ, এরই মধ্যে আরেকটি হচ্ছে, উপনিবেশ থেকে শোষণ করা সম্পদ ব্রিটেনে গিয়ে শিল্প-বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি যুগিয়েছিল — এই তত্ত্ব । বলা বাহুল্য, এটি একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে । উপনিবেশ থেকে সম্পদ যে বিদেশে পাচার হত, সে তো বলাই বাহুল্য ।//
বলা বাহুল্যই বটে!
“Compounding the Indian surpluses at 4 per cent, we obtain figures from 3,199,320 pounds to 3,779,264 pounds as the value of the surpluses taken by the British from South Asia, including Burma. Thus this surpluses alone would have financed anywhere between 75 to 95 per cent of the total British foreign investments.”
— Amiya Kumar Bagchi, Colonialism in Indian Subcontinent. OUP, Intro page xxxii

“Currently, the understanding of Indian economic change during colonial times is being damaged, especially among scholars with no first-hand knowledge of Indian data, by apparently authoritative estimates of growth of GDP and per capita GDP produced by Maddison (1995, 2003). Maddison (2003: Table A3-c) puts the per capita income of India (in 1990 Geary-Khamis dollars) as 533 in 1820, 533 in 1870, and 673 in 1913. The implied growth in the estimated per capita income between 1870 and 1913 is totally without basis.”
— Amiya Kumar Bagchi, Colonialism in Indian Subcontinent. OUP, Intro page xxxiv

//এই যে এত বিচিত্র সব সম্ভাব্য কারণ, এরই মধ্যে আরেকটি হচ্ছে, উপনিবেশ থেকে শোষণ করা সম্পদ ব্রিটেনে গিয়ে শিল্প-বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি যুগিয়েছিল — এই তত্ত্ব । বলা বাহুল্য, এটি একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে । উপনিবেশ থেকে সম্পদ যে বিদেশে পাচার হত, সে তো বলাই বাহুল্য ।//
আহা, কি অসাধারণ মহিমায় স্বীকৃতি পাচ্ছে উপনিবেশের অবদান। “একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে”!!

এর সঙ্গে যোগ করতে হবে,
//সেক্ষেত্রে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রেখাটি শোষণে নিম্নমুখী হয়ে পড়ার কথা, তা ঘটেনি । ভারতের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থেকেছে একই জায়গায়, এমন কি তার যৎসামান্য বৃদ্ধিও ঘটেছে, যদিও তা ইউরোপের তুলনায় খুবই নগণ্য।//

এর সঙ্গে যদি অনুগ্রহ করে এটাও যোগ করেন!
“This meant that 7.07 per cent of the gross domestic product of Bengal and Bihar was sent out of the country without any return. We should remember that the industrializing economy of England was not investing much more than 7 per cent of its GDP during precisely the decades that India was changing from an economy with a substantial share (ranging from 15 to 20 per cent) of the manufacturing sector in the GDP and employment of the economy to one in which the share fell well below 10 per cent over the course of the nineteenth century.”
— Amiya Kumar Bagchi, Colonialism in Indian Subcontinent. OUP, Intro page xxx

বাংলায় বললে, বাংলা বিহারের মোট জিডিপি-র [১৭৯৩-১৮০৭ সময়পর্বে] ৭.০৭% দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সেই সময় ইংল্যান্ড তার জিডিপি-র মোটামুটি ৭% দেশকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল করার জন্য খরচ করছিল। এ দেশে জিডিপি ও কর্মসংস্থান বিচারে মোট অর্থনীতির ১৫-২০% সেই সময়ের শুরুতে ছিল ম্যানুফাকচারিং সেক্টরে, সেটা ১০% -এরও নীচে নেমে গেল।

নাঃ, “একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে”-ই বটে!!

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

জয়ন্ত, তোমার তোলা প্রশ্নগুলো আকর্ষণীয় । আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করব, তবে এই মুহূর্তে একটু ব্যস্ত আছি । সময় দাও, প্লিজ ।

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

সত্যি বলতে কী, প্রশ্নগুলো যে এখানে পোস্ট করেছ সে খবরটা কাল জানলাম সবে ।


আপনার মতামত দিন

আপনার ই-মেইল অ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।