বিজ্ঞান ও যুক্তির সত্যসন্ধানী ভাবমূর্তিতে নাকি আজকাল একটু কালির ছিটে লেগেছে, ও সব নাকি আসলে ততটা ‘সত্য’ নয়, যতটা পশ্চিমী মগজ-ধোলাই। ও হচ্ছে এশিয়া, আমেরিকা আর আফ্রিকার প্রাচীন জ্ঞানকে দাবিয়ে রাখা আর অস্বীকার করবার হাতিয়ার, পশ্চিমী জ্ঞানকেই একমাত্র জ্ঞান বলে বাকি পৃথিবীর ওপর চাপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র। এই কারণেই নাকি আধুনিক যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান আর তারই উপজাত আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগে যুদ্ধ-বিগ্রহে, মানুষকে দমিয়ে রাখতে, নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করতে। কাজেই, এ হেন খারাপ জিনিসের জন্ম ও বাড়বৃদ্ধি যে এশিয়া আর আফ্রিকার উপনিবেশগুলোকে শোষণ না করে সম্ভব হতে পারত না, তাতে আর সন্দেহ কী?
আধুনিকতা ও পাশ্চাত্যের রোমান্টিক বিরোধিতার এই ফ্যাশনেব্ল্ বয়ানটি বিশ শতকের সাত থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক্স-এ খুব চলত। আজ তার সুদিন গিয়াছে, তবু আজও অনেকে নিয়মিতই এ নিয়ে ফেসবুকে চর্বিতচর্বণ করে থাকেন। ভারতের মত এক সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ইংরেজের হাতে দখল হয়ে যায়, আর, মোটামুটি ওই একই সময় থেকে ব্রিটেন-এ শুরু হয় শিল্প-বিপ্লব, অতএব সেটা নিশ্চয়ই ভারত থেকে লুঠ করা টাকাতেই সম্ভব হয়েছিল, এ রকম একটা ধারণা অ্যাকাডেমিক পণ্ডিত থেকে শুরু করে সাধারণ পড়ুয়া মানুষ অবধি অনেকেই পোষণ করে থাকেন। এ রোমান্টিকতা এমনিতে একটি নির্দোষ ভ্রমমাত্র, তবে তার পরিণতি সব সময় তত নির্দোষ না-ও হতে পারে। যেমন ধরুন, একে যদি শুধু ব্রিটিশ আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন, তাহলে ব্যাপারটাতে বেশ একটা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মেজাজ থাকে। কিন্তু এই একই যুক্তিটিকে আর পাঁচশো বছর মতন পিছিয়ে দিলেই ব্রিটিশের জায়গায় মুসলমান বসে যাবে, এবং তখন গল্পটা প্রাচীন ভারতের হেঁদুস্বর্গ যবন দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার হিন্দুত্ববাদী গল্পে গিয়ে দাঁড়াবে।
পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অত্যন্ত নিন্দনীয় কারণ তার পেছনে আছে ঔপনিবেশিক লুঠতরাজ – এই অত্যুৎসাহী নৈতিক বিচারের পেছনে অন্তত তিন রকমের ভুল আছে। এক, বিজ্ঞানের তত্ত্বের বিচারটা নৈতিক বিচার নয়, সত্য-মিথ্যের বিচার, এই সোজা কথাটা বুঝতে না পারা বা না চাওয়া। অঙ্ক, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা আর রসায়নের সূত্রগুলোর উৎস যা-ই হোক, তারা অত্যন্ত মূল্যবান কারণ তারা সত্য। এগুলো পশ্চিম জেনেছে আমরা পারিনি, এ কথাটাকে সহজে মানতে না শিখলে সত্য জানবার যোগ্য বলে নিজেকে দাবি না করাই ভাল। ওরা লুঠেরা তাই ওদের জ্ঞানটা মানব না – এ রকম কথার মধ্যে শিশুসুলভ অভিমান থাকতে পারে, নিজের অজ্ঞতা ঢাকার ধূর্তামিও থাকতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞা মোটেই নেই। বিজ্ঞান-টিজ্ঞান মেনে ব্রিটিশ যদি বন্দুক বানায়, তো তার বুলেট-টা ব্রিটিশের মতই ভারতীয়েরও বুক ফুঁড়ে দিতে পারে, কালিদাসের কাব্য পাণিনির ব্যাকরণ আর উপনিষদের দর্শনের দোহাই দিয়ে তার হাত থেকে বাঁচা যাবে না। দুই, ঔপনিবেশিক লুঠতরাজটাই পশ্চিমী বিজ্ঞানের সৃষ্টি ও বিকাশের কারণ – এ রকম ধারণাও ঐতিহাসিক সত্য থেকে বহু দূরে অবস্থিত। পশ্চিমী বিজ্ঞানের শিকড় আছে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিক বিজ্ঞান ও মধ্যযুগীয় আরব-রেনেসাঁর মধ্যে, এবং সেগুলোও আবার বহু হাজার বছরের প্রাচীন ব্যাবিলন-মিশর-ভারত-চিনের নানা অবদানে সমৃদ্ধ। জগৎটাকে জানতে হবে, এ তো মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা, নিছক ঔপনিবেশিক লুঠতরাজ তার কারণ হতে যাবে কেন?
প্রাচীন প্রজ্ঞাকে বাদ দিয়ে শুধু আধুনিক বিজ্ঞানকে পাকড়াও করবেন ভাবছেন? উঁহু, নাঃ। যদি ঐতিহাসিক শিকড়ের কথা বাদ দিয়ে শুধু আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের কথাই ধরেন, তাতেও বিশেষ কিছু সুবিধে হবে না। ভাস্কো ডা গামা ভারতে প্রথম পা দিলেন ১৪৯৮-তে, সে সময়ই পোল্যান্ডে কাজ করছেন কোপার্নিকাস, বাইবেল-বিরোধী মহাজাগতিক সত্যকে তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন। ১৬১৫-তে যখন স্যার টমাস রো মুঘল সম্রাটের দরবারে হাজির হলেন ব্যবসার অনুমতির আর্জি নিয়ে, তার দু বছর আগেই গ্যালিলিও চিঠি লিখে ফেলেছেন বেনিদেত্তো কাস্তেলি-কে, কোপার্নিকাস-এর বিশ্বতত্ত্বকে সমর্থন জানিয়ে। ১৬৯০-তে জোব চার্নক যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে কলকাতা নামক একটি গাঁ কিনছেন, তার বছর তিনেক আগেই নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ প্রকাশিত হয়ে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। ১৭৫৭-তে যখন পলাশি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সৈন্য বাংলা দখল করল, ততদিনে ইংলন্ডে শুরু হয়ে গেছে শিল্পবিপ্লব। উপনিবেশ থেকে লুঠ করা সম্পদ ইউরোপকে বড়লোক করেছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু টাকা লুটতে পারলেই বিজ্ঞান-টিজ্ঞান করা যায়, ব্যাপারটা ও রকম হাতের মোয়া নয়। ব্রিটিশদের বহু আগে থেকেই স্পেন দেদার লুটেছে লাতিন আমেরিকা থেকে, কিন্তু ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশেষ কিছুই অবদান রাখতে পারেনি, এবং ইউরোপকে আধুনিক রাষ্ট্র ও অর্থনীতি গড়বার রাস্তাও দেখাতে পারেনি।
তিন নম্বর ভুলটি হল আরও এককাটি সরেস, কারণ, এটি হচ্ছে ‘নিজের বেলায় আঁটিসুঁটি পরের বেলায় দাঁতকপাটি’ গোত্রের ভুল। যখন বলা হয় যে ভারতবাসী ছিল ধর্মভীরু শান্তিপ্রিয় চিন্তাশীল, আর ইউরোপীয়রা (কিম্বা মুসলমানেরা) বার বার এসে তাকে উত্ত্যক্ত করেছে, তখন ভুলে যাওয়া হয় প্রাচীন ভারতে নিম্নবর্ণের প্রতি অত্যাচারের কথা, নৃশংস যুদ্ধকেন্দ্রিক দুই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় মহাকাব্যের কথা, ছোট বড় রাজাদের ক্রমাগত অর্থহীন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা, এমন কি শ্রীলঙ্কা-বালি-যবদ্বীপ-ইন্দোচীনে ভারতীয়দের উপনিবেশ তৈরির কথাও। ইতিহাস নিয়ে চর্চা হোক (ঠিক ওই বস্তুটাই তো প্রাচীন ভারতে ছিল না), ইতিপূর্বে যেখানে যা অন্যায় অত্যাচার হয়েছে সে সব নিয়ে নির্মম কাটাছাঁড়াও হোক। কিন্তু, ‘আমরা হেরো অতএব আমরা বড্ড ভালমানুষ আর জ্ঞানী’ – এই আত্মপ্রতারণা দিয়ে আমাদের আখেরে কোনও লাভ হবে না।
ইউরোপের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিপ্লব ও ভারতে ঔপনিবেশিক শোষণের সম্পর্ক নিয়ে কথাবার্তা আরও এগোবার আগে আধুনিক যুগ নিয়ে একটা খুব ছোট্ট কথা বলে নিই। আচ্ছা, ইউরোপে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উদ্ভবের পর আমরা মোটের ওপর আগের চেয়ে ভাল আছি, না খারাপ আছি? প্রশ্নটি কঠিন, এবং এ লেখাটি সে বিষয় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ চর্চার জায়গাও নয়। তবু, একটা প্রাথমিক ইঙ্গিত পাবার জন্য নিচের লেখচিত্রে (চিত্র-১) চোখ বোলানো যাক। ১৭৭০ সালে এশিয়ায় সদ্যোজাত শিশুর সম্ভাব্য গড় জীবনকাল (Life Expectancy at Birth, or LEB) ছিল সাতাশ-আটাশ, ইউরোপে তা ছিল পঁয়ত্রিশ মতন। এই সংখ্যাগুলোই বর্তমানে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে মোটামুটি একাত্তর ও আশি। আধুনিকতা খুব বেশি খারাপ নয়, কী বলেন!
তা সে যা-ই হোক, আমরা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ঔপনিবেশিক শোষণ সম্পর্কে দুটো কথা খুব শোনা যায় – (১) ১৭০০ সাল নাগাদ ভারতের জাতীয় উৎপাদন গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক উৎপাদনের ২৪ শতাংশ মত ছিল, ব্রিটিশ অত্যাচারে তা শেষে নেমে আসে ৪ শতাংশে। (২) এই ঔপনিবেশিক শোষণে তৈরি হয় বিপুল অর্থনৈতিক অসাম্যও। এ দুটো কথা কিন্তু ততটা মিথ্যে নয়, শুধু একটু ঘোলাটে। এর অর্থ আসলে যে ঠিক কী, তা বোঝা যাবে এটিকে বিস্তারিত তথ্যের প্রেক্ষিতে স্থাপন করলে।
এখন এই প্রশ্নটি আলাদা করে বিচার করে দেখা যাক যে, দীর্ঘ ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ভারত ও বাকি বিশ্বের অর্থনৈতিক ওঠানামা ও তার পরস্পর-সম্পর্কের নকশাটি ঠিক কী রকম। নিচের সারণি (চিত্র-২) দেখুন, বিশ্লেষণে পরে আসছি। এ সারণি শুধুমাত্র ভারত সম্পর্কেই। অর্থাৎ, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতের মোট ও মাথাপিছু উৎপাদন, উৎপাদন বৃদ্ধির হার, সেটা পৃথিবীর মোট উৎপাদনের কত শতাংশ, ভারতে জনসংখ্যারই বা তখন কি দশা, সে সব তথ্য এখানে পাবেন এক নজরেই।
এর সাথে চোখ বুলিয়ে নিন এই ‘গ্রাফ’ বা লেখচিত্রটিতেও (চিত্র-৩), সুবিধে হবে। এতে আছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে অর্থনৈতিক বিবর্তনের চিত্র, এক নজরে (গোটা পৃথিবীর, শুধু ভারতের নয়)। প্রাচীন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিভিন্ন কালপর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা ভাবে কতটা অবদান রাখত মোট পার্থিব উৎপাদনে, তার চিত্র এখানে পাবেন।
দ্বিতীয় ছবি, অর্থাৎ সারণিটি ভাল করে দেখুন। প্রাচীন যুগে ভারত ও চিন যে অর্থনীতিতে পৃথিবী-সেরা ছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, খ্রিস্টীয় শতকের গোড়ার দিকে গোটা পৃথিবীর তৎকালীন অর্থনৈতিক উৎপাদনের যথাক্রমে প্রায় ৩২ ও ২৬ শতাংশের দায়িত্ব তারা নিতে সক্ষম ছিল। শুধু উৎপাদন-কুশলতা বা উন্নত সভ্যতা তার কারণ নয়, একটি বড় কারণ জনবলও (জনসংখ্যা-স্তম্ভটি লক্ষ করুন)। ওই জনবিরল পৃথিবীতে যে দেশে বেশি লোক, সে দেশেই বেশি বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, এবং সেহেতু বেশি বেশি উৎপাদন। অবশ্য, উল্টোটাও সমানভাবে ঠিক। বেশি উৎপাদনই আবার বেশি জনবলকে টিঁকিয়ে রাখতে পারে। কাজেই, সভ্যতার উন্নতি ও উৎপাদন-কুশলতার বিষয়টি পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়ারও কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। তবে কিনা, ইতিহাসের অগ্রগতির সাথে সাথে ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটি ক্রমশই খোয়াতে থাকে (পঞ্চম স্তম্ভটি দেখুন)। খ্রিস্টাব্দের শুরুতে যেখানে ভারতীয় উৎপাদন পৌঁছেছিল মোট পার্থিব উৎপাদনের ৩২ শতাংশে, সেখানে হাজার খ্রিস্টাব্দে তা নেমে দাঁড়াল ২৮ শতাংশে, ষোলশোতে মোটামুটি ২২.৫, সতেরশোতে সামান্য বেড়ে ২৪ হলেও আঠেরোশোতেই আবারও ১৬ এবং উনিশশো তেরোতে ইংরেজ আমলের শেষদিকে প্রায় ৭.৫। ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে যাবার সময়ে অধঃপতন চূড়ান্ত, প্রায় ৪ শতাংশ। এবং, এই অধঃপতন মোটের ওপর ধারাবাহিক, ওঠাপড়ার গল্প খুব একটা নেই।
এখন, ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভারত দখল হবার আগে পর্যন্ত ইংরেজরা এ দেশে শুধুই ব্যবসা করেছে, সেখানে গা জোয়ারির প্রশ্ন ওঠে না। কাজেই, ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে ভারতের অর্থনৈতিক অধঃপতনের গল্পটা বড়জোর অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি অবধি টেনে নিয়ে যেতে পারবেন (আর মুসলমানী অত্যাচারে দেশ ছারখার হওয়ার গল্প বড়জোর ১২০০ অবধি), কিন্তু তার আগে? তার বহু আগে থেকে সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক উৎপাদনে ভারতের ভাগ ক্রমাগত নেমে আসার ব্যাখ্যাটা তবে কী? ঠিক আছে, বিষয়টা খতিয়ে দেখা যাক। এমন কি হতে পারেনা যে, হাজার সালের আগের পতনটা আকস্মিক, আর হাজার সাল থেকে এই যে অনবরত মসৃণ পতন, তার পেছনে বাস্তবিকই প্রথমে মুসলমান ও পরে ব্রিটিশদের লুণ্ঠনই দায়ী? ব্যাপারটা এমন নয় তো যে, ‘ওরা’ এগিয়েছে আমাদের শোষণ করেই, তাই ওরা হয়েছে বড়লোক আর আমরা ক্রমেই হয়েছি গরিব? সারণিটি (চিত্র-২) খুঁটিয়ে দেখলে সে প্রশ্নেরও অনেকটাই উত্তর পাওয়া যাবে – দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ স্তম্ভগুলোতে একটু নজর দেবেন। ভাল করে ভেবে দেখুন, আমাদের শোষণ করাটাই যদি অন্যদের উন্নতির একমাত্র কারণ হত, তাহলে ওরা বড়লোক হবার সাথে সাথে আমরা সমান তালে গরিব হতাম। অথচ স্পষ্টতই ঘটনা তা নয়, কারণ ওই সময়ে ক্রমাগতই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটেছে, খুব ধীর লয়ে হলেও। ওই সময়কালে উৎপাদনের মোদ্দা অর্থমূল্য (স্তম্ভ-২), মাথাপিছু আয় (স্তম্ভ-৩) এবং জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার (স্তম্ভ-৪) – এই তিনটি হিসেবেই ক্রমাগত সমৃদ্ধি ঘটেছে, নিজেদের অতীতের তুলনায় অন্তত আমরা গরিব হয়ে পড়িনি। প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যরা তবে সমৃদ্ধ হল কীভাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে এই গোটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটিকে একটিমাত্র ঐতিহাসিক বোধের আওতায় আনতে হবে। আর তা যদি করতে হয়, তাহলে বিনা ওজর-আপত্তিতে প্রথমেই এইটা স্বীকার করে নিতে হবে যে, ভারত সজোরে দৌড় শুরু করেও গতি বাড়াতে পারেনি, আর বাকিরা অর্থনৈতিক উন্নতির গতি বাড়িয়ে বাড়িয়ে ক্রমশই তাকে ধরে ফেলেছে বা টপকে গেছে। এবং, এই টপকে যাওয়ায় কোনওমতেই ব্রিটিশ বা মুসলমানেরা প্রথম নয়, এগিয়ে আছে চিন, যে নাকি হাজার খ্রিস্টাব্দ থেকেই ভারতকে প্রবল বেগে তাড়া করে এবং অচিরেই ধরে ফেলে (তৃতীয় ছবি, অর্থাৎ গ্রাফ-টি দেখুন)। ইউরোপেরও এগোনোর গল্প শুরু হয়েছে মোটামুটি ওই একই সময় নাগাদ, তবে ১৭০০ সালের আগে তারা ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। এই গোটা সময়টাই ভারতের কাছে শুধুই পিছিয়ে পড়ার গল্প। ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক নানা টানাপোড়েনে বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতা ওঠে আর পড়ে, একে বুঝতে হবে নির্মোহ ও কঠোর তথ্য-যুক্তি দিয়ে, এখানে ‘বঞ্চিত’ ব্র্যান্ডের আখাম্বা সেন্টিমেন্ট আর অন্ধ ঐতিহ্যপ্রেমের কোনও স্থান নেই।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে, অর্থাৎ, প্রাক-ব্রিটিশ অর্থনীতিতে অধিকতর ‘সাম্য’ বিরাজ করত কিনা সেই প্রশ্নে। ওইসব সময়ের তথ্য পাওয়া খুবই কঠিন, অতএব কঠিন তৎকালীন অর্থনীতির সাম্য-অসাম্য মাপাও। তবু, অর্থনীতিবিদেরা চেষ্টার ত্রুটি করেন নি, যতটা পারা যায় কাজটা করার চেষ্টা করেছেন। নিচের সারণি দেখুন (চিত্র-৪)। এখানে পাওয়া যাচ্ছে ১৭৫০ সালে ভারতে আয়-বন্টনের চিত্র, এক নজরে। এতে দেখা যাচ্ছে, তখন রাজা-গজা-জমিদার শ্রেণি ছিল মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ, এবং জাতীয় মোট আয়ে তাদের ভাগ ছিল ১৫ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ছিল গড় জাতীয় আয়ের ১৫ গুণ। তাদের নিচে ছিল ব্যবসায়ী ও রাজকর্মচারী শ্রেণি, তারা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ, জাতীয় মোট আয়ে তাদের ভাগ ছিল ৩৭ শতাংশ, এবং মাথাপিছু আয় ছিল গড় জাতীয় আয়ের ২.২ গুণ। তারও নিচে ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির লোকজন, যারা ছিল মোট জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ, এবং জাতীয় মোট আয়ে তাদের ভাগ ছিল ৪৫ শতাংশ, যদিও মাথাপিছু আয় ছিল গড় জাতীয় আয়ের .৬ (দশমিক ছয়) গুণ। আর, সবচেয়ে নিচে ছিল আদিবাসী জনসমাজ, যারা ছিল মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ, এবং জাতীয় মোট আয়ে তাদের ভাগ ছিল ৩ শতাংশ, এবং মাথাপিছু আয় ছিল গড় জাতীয় আয়ের .৩ (দশমিক তিন) গুণ। আদর্শ সাম্যের দশা, কি বলুন!
না, এত সব কথাবার্তার উদ্দেশ্য মোটেই এইটা প্রমাণ করা নয় যে, ঔপনিবেশিক শোষণ বলে কিছু ছিল না, বা, সেটা খুব ভাল জিনিস ছিল, বা যেটুকু খারাপ ছিল তার গুরুত্ব যথেষ্ট বেশি নয়। আমার আপত্তি শুধু উপনিবেশবিরোধী কান্নাকাটি মাত্র সম্বল করে মানুষের ইতিহাস ও বিজ্ঞান নিয়ে ভুয়ো-নৈতিক ভাটচর্চায়। এইটা পরিষ্কার করে বুঝতে হবে যে, এ ধরনের সেন্টিমেন্ট্যাল তত্ত্বায়নে ঐতিহাসিক কার্যকারণকে উল্টে ফেলা হয়। ইউরোপীয়রা উপনিবেশকে শোষণ করেছিল বলেই উন্নত হয়েছিল তা নয়, বরং ঠিক উল্টো, তারা উন্নত হয়েছিল বলেই উপনিবেশ দখল করতে পেরেছিল। হ্যাঁ, তবে, সেইসঙ্গে আবার এটাও সত্যি যে, ওই দখল ও লুঠের সুযোগ নিয়েই তারা তাদের সমৃদ্ধি অনেকখানি বাড়িয়ে তুলেছিল, এবং তার ফলে তাদের সাথে আমাদের যে পার্থক্য ইতিমধ্যেই ছিল তা আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। এটা শুধু পদার্থবিদ্যা আর রসায়নে উন্নতির প্রশ্ন নয়, কিম্বা শুধু বন্দুক আর ইঞ্জিন তৈরির প্রশ্নও নয়, ইতিহাস ভূগোল সমাজ বিষয়ক বোধেরও প্রশ্ন। যে নির্বোধ দেশীয় রাজাটি আজ ভাবছে ইউরোপীয় সেনার সাহায্য নিয়ে পাশের রাজাটিকে কাত করলেই কেল্লা ফতে, তার সাথে ইউরোপীয় সেনাপতিটির তফাত শুধু নিষ্ঠুরতা আর ধূর্ততায় নয়, সমাজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বোধবুদ্ধিতেও।
এবার আরেকটি সারণিতে (চিত্র-৫) নজর দেওয়া যাক, যাতে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর নানা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে মাথাপিছু জাতীয় আয়, ১৫০০ সাল থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত। রক্ত-নিম্নরেখিত অংশ দুটি লক্ষ করুন। পশ্চিম ইউরোপের মাথাপিছু আয় ১৫০০ সাল থেকেই এশিয়ার ওপরে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি। পরবর্তীকালে তা বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, ১৯১৩-তে দাঁড়িয়েছে ১৫০০-র তুলনায় প্রায় সাড়ে চার গুণ। ততদিনে এশিয়ার বৃদ্ধি কিন্তু ঋণাত্মক হয়ে যায়নি, তবে তা যৎসামান্য – মাত্রই আটভাগের একভাগ। নজর করে দেখুন, এশিয়া পিছিয়ে পড়েছে শুধু ইউরোপের তুলনায় নয়, একমাত্র আফ্রিকা ছাড়া বাকি সকলের থেকেই। অর্থাৎ, শুধু এশিয়ার সম্পদ ফাঁকা করে করেই ওরা বড়লোক হচ্ছে, এ হিসেব মোটেই মিলছে না। এর পরে আমরা দেখব, এশিয়ার মধ্যে ভারতকে বিশেষভাবে ধরলে এ সত্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
এবার হাজির করব একটি লেখচিত্র (চিত্র-৬), যাতে রয়েছে ভারত, চিন, জাপান ও কয়েকটি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, ১৫০০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত। লক্ষ করুন, ব্রিটেন তখন থেকেই ভারতের থেকে এগিয়ে শুরু করছে (অন্য ইউরোপীয় ও এশীয় দেশগুলোও), এবং সাড়ে আঠেরোশো সাল অবধি মোটামুটি সমগতিতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে, যদিও ভারত ও চিন প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছে, এমন কি চিন যৎসামান্য নেমেও যাচ্ছে (চিনের অবাক করা উত্থান এর ঠিক পরের গল্প, যদিও এখানে প্রাসঙ্গিক না)। ব্রিটেনের বাড়বাড়ন্ত অন্য সব দেশের চেয়েই অনেক বেশি। খুঁটিয়ে নজর করুন, ১৫০০ সাল থেকেই ইউরোপীয় দেশগুলোর এই যে মসৃণ অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, এ কিন্তু ঘটে চলেছে ইংরেজরা ভারতে আসার বহু আগে থেকেই। আরও নজর করুন, ভারত দখল করে ব্রিটেনের অর্থনীতি ফুলেফেঁপে ওঠার তত্ত্ব যদি সত্যি হত, সেক্ষেত্রে ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অর্থনীতিতে এক বাড়তি গতি আসার কথা ছিল, তেমন কোনও লক্ষণ কিন্তু মোটেই দেখা যাচ্ছে না, এবং লেখচিত্র অনুযায়ী সেই বাড়তি গতিসঞ্চারটুকু আসলে ঘটছে আরও প্রায় একশো বছর পরে। দাবি উঠতে পারে, ১৫০০ সাল নাগাদ ভারত দখল হয়ত হয়নি, কিন্তু আমেরিকাতে ইউরোপীয় লুণ্ঠন তো ছিলই, কাজেই ওই বৃদ্ধিটাও ঔপনিবেশিক শোষণের ফল হিসেবেই ধরতে হবে। কিন্তু, সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে ওই সময় স্পেন-এর অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর থেকে বেশ খানিকটা বেশি হবার কথা, অথচ তা কিন্তু ঘটেনি। স্পেনের অর্থনীতি অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় বরাবরই দুর্বল থেকেছে, এবং ব্রিটেন বরাবরই থেকেছে অনেক এগিয়ে। অবশ্য, আরেকটি জরুরি প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে। এমন তো নয় যে, ১৮৫০ সাল নাগাদ যে প্রচণ্ড বাড়তি বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, সেটাই আসলে ভারতে ঔপনিবেশিক শোষণের ফল, যদিও নানা কারণে তা ফলেছে প্রায় একশো বছর দেরিতে? সত্যিই তো, অর্থনৈতিক কার্যকারণ বিলম্বিত হতেই পারে, সব সময় তার ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে দৃষ্টিগোচর হয় না। এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে জানতে হবে, ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব ঘটবার কী কী কারণ অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করে থাকেন। সেই কথাতেই যাব এর পরে, তবে আপাতত একটা জিনিস শুধু লক্ষ করতে বলব। সেক্ষেত্রে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রেখাটি শোষণে নিম্নমুখী হয়ে পড়ার কথা, তা ঘটেনি। ভারতের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থেকেছে একই জায়গায়, এমন কি তার যৎসামান্য বৃদ্ধিও ঘটেছে, যদিও তা ইউরোপের তুলনায় খুবই নগণ্য।
ব্রিটেনে শিল্প-বিপ্লব কেন হয়েছিল সে নিয়ে পণ্ডিতেরা পাহাড়প্রমাণ বই ও গবেষণাপত্র রচনা করেছেন, বইপত্তর পড়লে সে সব তো জানা যায়ই, এমন কি অন্তর্জালে খানিক সময় আর বুদ্ধি খরচা করে খোঁজাখুঁজি করলেও আজকাল বেশ কিছু কথা জেনে ফেলা যায়। তাছাড়া, যাঁরা পড়াশোনা করতে ভালবাসেন তাঁরা অনেকে সাধারণ জ্ঞান হিসেবেই এ সব বিষয়ে কিছু কিছু জানেন। কাজেই, এখানে সবিস্তারে সে কথা ফেঁদে বসা অর্থহীন। তবু, অন্তত মোদ্দা কথাটা না আউড়ে নিলে আলোচনায় ঢোকা মুশকিল। কেন শিল্প-বিপ্লব ব্যাপারটা আদৌ ঘটল, এবং ওই ব্রিটেনেই ঘটল, সে নিয়ে অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশেষজ্ঞরা আজও মাথা খুঁড়ে মরেন। এ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে, এবং আজ পর্যন্ত যত রকমের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এসেছে তার প্রায় কোনওটাই পুরোপুরি সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। একজন বিশেষজ্ঞ তো একে অর্থনৈতিক ইতিহাসের ‘হোলি গ্রেইল’ আখ্যা দিয়ে বসে আছেন! তবু, শিল্প-বিপ্লবের যে সমস্ত বস্তুগত কারণের কথা অর্থনীতির পাঠ্যে খুব নিয়মিতভাবে পাওয়া যায় সেগুলো এই রকম – (১) বহু আগে থেকেই কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধি, (২) কয়লা ও লোহার সহজলভ্যতা, (৩) কাপড় বোনবার যন্ত্র, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, কোক কয়লা ও ধাতব লোহা তৈরির প্রযুক্তি ইত্যাদির আবিষ্কার, (৪) রেল, জল ও সড়ক পথে পরিবহন ব্যবস্থার প্রচণ্ড উন্নতি, (৫) জনসংখ্যার বৃদ্ধি, এই সব। এর সঙ্গে কেউ কেউ যোগ করতে চান নানা ঐতিহাসিক পরিস্থিতিগত ‘ফ্যাক্টর’, যেমন, আগের শতাব্দীতেই নিউটন সাহেবের হাতে ‘বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ সমাধা হওয়া, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় যুদ্ধবিগ্রহ কম হওয়ায় বেশ একটু শান্তির পরিবেশ বজায় থাকা, ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূলে সরকারি নানা নিয়মকানুন, এই সব। আবার, কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ ব্রিটেনের বিশেষ কিছু সমাজতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কথাও বলেছেন, যেমন, অন্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় ব্রিটেনের বড়লোকেরা লাভের মুখ দেখার জন্য শ্রমিক-মিস্তিরি-কারিগর শ্রেণির লোকজনকে বেশি বেশি পাত্তা দিতেন, ফলে ওখানে এই সব শ্রমিক-মিস্তিরি-কারিগর শ্রেণির লোকজন যন্ত্রপাতির উন্নতিসাধনে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন। এমন কি, এর পেছনে ধর্মীয় মতাদর্শগত প্রভাব কাজ করে থাকতে পারে কিনা, এ হেন সম্ভাবনাকেও গবেষকরা কিন্তু ফেলে দেননি। সর্বকালের সেরা সমাজতত্ত্ববিদদের একজন, জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবার বলেছিলেন ‘প্রোটেস্টান্ট ওয়ার্ক এথিক্স’-এর কথা। অর্থাৎ, প্রোটেস্টান্ট ধর্মে যে কঠোর পরিশ্রম ও আত্মনিয়োগের কথা আছে, সেই মতাদর্শের কারণেই প্রোটেস্টান্ট ব্রিটেনের পুঁজিপতিরা কঠোর পরিশ্রম করে লক্ষ্যবস্তু অর্জনের প্রতিযোগিতায় ক্যাথলিক ফ্রান্স-স্পেন-ইতালিকে পেছনে ফেলেছেন, এই রকমই ছিল তাঁর বক্তব্য। ওয়েবার-এর এই অবস্থানকে আরও পোক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন ব্রিটিশ সমাজতত্ত্ববিদ রবার্ট মার্টন এবং ওলন্দাজ বিজ্ঞান-ইতিহাসবিদ রেইয়ার হুইকাস। এই যে এত বিচিত্র সব সম্ভাব্য কারণ, এরই মধ্যে আরেকটি হচ্ছে, উপনিবেশ থেকে শোষণ করা সম্পদ ব্রিটেনে গিয়ে শিল্প-বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি যুগিয়েছিল – এই তত্ত্ব। বলা বাহুল্য, এটি একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে। উপনিবেশ থেকে সম্পদ যে বিদেশে পাচার হত, সে তো বলাই বাহুল্য। নানা রকম ট্যাক্স আদায় করে, তুলো নীল শস্য ইত্যাদি কাঁচামাল জোর করে এখানে চাষ করিয়ে তারপর ওদেশে রপ্তানি করে, যন্ত্রে তৈরি বিলিতি বস্ত্র আমদানি করে এদেশে বেচে, এদেশের জোত জমি কারখানার মালিক হয়ে, উৎপাদন-ব্যবসা-বিপণন সংক্রান্ত নানা ব্যাপারে পরামর্শদাতা ও ব্যবস্থাপক হয়ে। এই রকম সব কায়দায়। ওদিকে আমেরিকাতে ছিল চিনি আর ক্রীতদাসের ব্যবসা। এই সম্পদ যে ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। প্রথমে দাদাভাই নৌরোজি এবং পরে মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, পশ্চিমবঙ্গে রমেশচন্দ্র দত্ত, এবং তারও পরে আরও অনেকেই, এই রকম ‘কলোনিয়াল ড্রেন’ বা ঔপনিবেশিক সম্পদ-ক্ষরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। অবশ্য, এই সম্পদের সবটাই পাচার হওয়া সম্ভব হত না, তার একটা বড় অংশ এখানেই লেগে যেত ঔপনিবেশিক পরিকাঠামো তৈরি ও যুদ্ধবিগ্রহে। এখন, প্রশ্ন হচ্ছে, এই সম্পদ-পাচার কি এতটাই বেশি ছিল যে তা না হলে ইউরোপে শিল্প-বিপ্লব হতেই পারত না? এর উত্তরে আজকের বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই বলছেন, তা মোটেই নয়, তা না হলেও শিল্প-বিপ্লব মোটেই আটকাত না, কারণ ব্রিটেন তথা ইউরোপের মোট পুঁজির তুলনায় এ ছিল খুবই সামান্য।
কথাটাকে যাচাই করতে গেলে বাণিজ্য সংক্রান্ত কিছু তথ্য গুছিয়ে হাজির করা দরকার। কাজেই, আসছে আরও একটি সারণি (চিত্র-৭)। নিচে দেওয়া ছবি দেখুন। এখানে পাওয়া যাচ্ছে অষ্টাদশ শতক জুড়ে বিশেষ কয়েকটি বছরে ব্রিটেনের বহির্দেশীয় জলপথ বাণিজ্যের আয়। ভাল করে দেখুন, এক নজরে পাওয়া যাচ্ছে তিনটি বাণিজ্য-গন্তব্যের হিসেব – ভারত (ইস্ট ইন্ডিয়া), আমেরিকা এবং ইউরোপ (উত্তর ও দক্ষিণ)। সারণি থেকে খুবই স্পষ্ট, ব্রিটেনের বহির্বাণিজ্যের সিংহভাগটাই ছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাথেই। আমেরিকার সাথে তার থেকে বেশ খানিকটা কম, এবং ভারতের সাথে তারও চেয়ে অনেকটাই কম, যাকে নগণ্য বললেই হয়। রক্ত-নিম্নরেখিত সংখ্যাগুলোতে বিশেষ মনোযোগ দেবেন। এ সারণি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাবে, ব্রিটেনের দুই কলোনি অর্থাৎ আমেরিকা ও ভারতের তুলনায় ইউরোপের সাথেই বাণিজ্য চলত অনেক বেশি। এতে অবাক হবার কিছুই নেই, বরং এইটা না হলেই অবাক হতে হত। ইউরোপের দেশগুলোই তখন পৃথিবীর সমৃদ্ধতম দেশ (ব্রিটেনের থেকে হয়ত একটু কম), কাজেই ব্রিটিশ কারখানায় তৈরি পণ্যের সবচেয়ে শাঁসাল ক্রেতা তো তারাই হবে।
কিন্তু, এখনও বোধহয় তত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। বাণিজ্য তো একটা পরোক্ষ ব্যাপার। বাণিজ্য করলে সম্পদ বাড়ে ঠিকই, কিন্তু বাণিজ্য জিনিসটা নিজেই যে জাতীয় সম্পদের সমার্থক, এমন তো আর নয়। তাহলে, ব্রিটেনের জাতীয় সম্পদের সাথে ভারত থেকে ওদেশ যাওয়া বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের একটা সরাসরি তুলনা হলে ভাল হত, তাই না? আচ্ছা, দেখা যাক সে রকম কিছু পাওয়া যায় কিনা। নিচের ছবিটা দেখুন (চিত্র-৮), এখানে এক নজরে পাবেন ভারত ও ব্রিটেনের বাৎসরিক জাতীয় আয় বা ‘জিডিপি’-র সাথে ভারত থেকে ওদেশ যাওয়া বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের সরাসরি তুলনা, শতাংশের হিসেবে। চোখ বুলোলেই বুঝবেন, দুটো দেশের ক্ষেত্রেই এই অনুপাতটি মোটামুটি এক শতাংশের ধারেকাছে! এটা কীভাবে হয়, দুটো দেশের আয় সমান নাকি? হ্যাঁ, ঠিক তাই, মোট আয়ের নিরিখে। কিন্তু ভারতের লোকসংখ্যা যেহেতু ব্রিটেনের তুলনায় অকল্পনীয় রকম বেশি, কাজেই মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারত হতদরিদ্র, ব্রিটেন ধনী। তা, সে অবশ্য অন্য প্রশ্ন। ধনী গরিবের প্রশ্ন এখানে আসছে না, কারণ, এখানে আমরা মোট আয়ের সাথে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের সম্পর্ক কী শুধু এইটুকু নিয়েই মাথা ঘামাতে চাইছি। এখানে যেটা দেখবার সেটা হল এই যে, ভারত ও ব্রিটেন দুটো দেশের ক্ষেত্রেই এই বাণিজ্য-উদ্বৃত্তটি মাত্রই এক শতাংশের ধারেকাছে। অতএব, এটা না হলে ব্রিটেনের শিল্প-বিপ্লব ব্যাপারটাই পুরো আটকে যেত, এতটা ভেবে নেওয়া বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি।
তাহলে, এখন আমরা আলোচনার শেষপর্বে এসে পড়েছি। এবার একটা জিনিস ভেবে দেখা যাক। আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় ছিল, ইউরোপের বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক বিপ্লব ঘটার জন্য উপনিবেশ থেকে সম্পদের পাচার অপরিহার্য ছিল কি না। এখনও পর্যন্ত আমরা যে তথ্যাবলী হাজির করেছি তার ইঙ্গিতটা হচ্ছে, না, তা ছিল না। কিন্তু, এও শেষ বিচারে এক পরোক্ষ ইঙ্গিতই বটে। এখনও পর্যন্ত আমরা নজরের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিলাম অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে। পেছনে যুক্তিটা ছিল, বেশি আর্থিক সমৃদ্ধি বেশি বেশি বৈজ্ঞানিক-প্রাযুক্তিক আবিষ্কারকে সম্ভব করে তুলবে, এবং তার ফলে আবার ওই আবিষ্কারগুলোকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আরও বেড়ে উঠবে। কাজে কাজেই, যদি এইটা প্রমাণ করা যায় যে ইউরোপের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ঔপনিবেশিক সম্পদের পাচার অপরিহার্য ছিল (বা ছিল না), তাহলেই প্রমাণ হবে যে, ইউরোপের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সমৃদ্ধির জন্যও ঔপনিবেশিক সম্পদের পাচার অপরিহার্য ছিল (বা ছিল না)। এখন প্রশ্ন, আমরা কি এই পরোক্ষ অনুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য, না আরও প্রত্যক্ষ তথ্যের খোঁজখবর করতে পারি?
এর উত্তর হচ্ছে, হয়ত তা পারি। যেমন ধরুন, আমরা সরাসরি খোঁজ করে দেখতে পারি, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময়কাল বরাবর ইউরোপে বিজ্ঞানচর্চার ধারায় কোনও পরিবর্তন এসেছিল কিনা। সেটা মাপার চেষ্টা করা যেতে পারে, যদি ওই সময় নাগাদ ইউরোপের বিজ্ঞানচর্চা সংক্রান্ত কোনও একটি রাশির পরিবর্তনসূচক একগুচ্ছ তথ্য জোগাড় করা যায়। যেমন, বিজ্ঞানীর সংখ্যা, বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রিকার সংখ্যা, আবিষ্কারের সংখ্যা, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় খরচের পরিমাণ, এই ধরনের কিছু একটা। এ রকম তথ্য আছে কি? সুখের বিষয়, তা আছে, এবং বেশ হইচই করেই আছে। প্রখ্যাত বিজ্ঞান-ঐতিহাসিক ডেরেক জে ডি সোলা প্রাইস তাঁর ‘লিটল্ সায়েন্স, বিগ সায়েন্স’ (১৯৬২) নামক ক্লাসিক গবেষণাগ্রন্থে এই বিষয়ে বিস্তর তথ্য খুব গুছিয়ে হাজির করেছেন। সত্যি বলতে কী, এই গবেষণাটির মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের বিকাশকে মাপার একটি নতুন বিজ্ঞান সৃষ্টি করেন, যাকে আজ বলা হয় ‘সায়েন্টোমেট্রি’। সেই বইয়েরই একটি লেখচিত্র (চিত্র-৯) এখানে হাজির করলাম, এতে দেখা যাবে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যকাল থেকে বিশ শতকের শেষভাগ অবধি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রিকার সংখ্যাবৃদ্ধির জ্যামিতিক নকশা। সাধারণ গবেষণাপত্রিকা ও সারসংক্ষেপ গবেষণা পত্রিকা – দুটিরই প্রকাশ সংক্রান্ত তথ্য এখানে পাওয়া যাবে। এমনিতে এই ধরনের বৃদ্ধিগুলোর ছাঁচটা ব্যাঙ্ক-আমানত বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির ছাঁচের অনুরূপ, যাকে গণিতের ভাষায় বলে ‘এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ’ বা সুচকীয় বৃদ্ধি। লক্ষ করুন, এ লেখচিত্রে উল্লম্ব অক্ষের রাশিটি সমান্তর প্রগতিতে বাড়ছে না, বাড়ছে গুণোত্তর প্রগতিতে। অর্থাৎ, দশ কুড়ি তিরিশ বা একশো দুশো তিনশো এভাবে নয় – দশ একশো হাজার দশহাজার লক্ষ এইভাবে, মানে প্রতি ধাপে দশগুণ করে। এ রকম বৃদ্ধির লক্ষণটি হচ্ছে, রাশিটি একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর দ্বিগুণ হতে থাকে (ফিক্সড্ ডিপোজিট স্কিম-এর ক্ষেত্রে যা হয় আর কি)। আরও লক্ষ করুন, এবং এটাই সবচেয়ে জরুরি, লেখচিত্রটি কিন্তু সবসময়ই তীব্র বেগে ওপরে উঠছে, এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময়কালটি জুড়ে (১৭৫৭ – ১৯৪৭) তার মধ্যে আলাদা করে আর কোনও বিশেষ ঘটনা বা নকশা নজর করা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে আমার যা বলবার ছিল, এতক্ষণে বোধহয় তা বলে উঠতে পেরেছি। তবু, একটা উপসংহার না টানলে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে। এই যে এত সব ব্যাখ্যা, সংখ্যা আর ছবি ছাপাটি এতক্ষণ ধরে দিলুম, তাতে মোদ্দা কথা কি কি দাঁড়াল? এক এক করে দেখা যাক। প্রথমত, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিচার হচ্ছে মূলত সত্য-মিথ্যার বিচার, সেখানে নৈতিক বা নান্দনিক বিচারের স্থান যদি বা থেকে থাকে, তো সে খুবই গৌণ। কাজেই, ‘গবেষণার অর্থের যোগান যেভাবে এসেছে তা অনুমোদন করিনা অতএব গবেষণার ফলাফলগুলোও মানব না’, এ রকম যুক্তি দেওয়া চলে না, গবেষণার ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতার বিচার সম্পূর্ণ আলাদা। দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক সত্যগুলো জানতে গেলে নির্মোহভাবে তথ্য-যুক্তি দিয়ে বিচার প্রয়োজন। জাত্যভিমান এবং নৈতিক হাহাকার ও অভিযোগ সেখানে যদি বা থাকে, তো তাকে সত্যের পটভূমিকায় খাড়া করা প্রয়োজন, সেগুলো দিয়ে সত্যকে প্রতিস্থাপিত করার দরকার নেই। তৃতীয়ত, তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, খ্রিস্টীয় প্রথম হাজার বছরে অর্থনীতিতে ভারত ছিল পৃথিবী সেরা (চিন তার পরেই), যদিও পরবর্তীকালে ভারত ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে, প্রথমে চিন ও পরে অন্যদের কাছে (আরও পরে চিনও)। মুসলমান বা ব্রিটিশ আমলে এই দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক প্রবণতা চালু থেকেছে মাত্র, নতুন করে সৃষ্টি হয়নি, হয়ত অধঃপতন দ্রুততর হয়েছে। চতুর্থত, ব্রিটিশরা আসার আগে থেকেই ভারতীয় সমাজে যথেষ্ট অসাম্য ছিল। পঞ্চমত, ভারতে দখলদারি শুরু করার অনেক আগে থেকেই ইউরোপে অর্থনীতি ও বিজ্ঞানের বিকাশ শুরু হয়েছে, যার সুবাদে তারা ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে সারা পৃথিবীতে, ভারত হয়ে থেকেছে কুয়োর ব্যাঙ। ষষ্ঠত, ঔপনিবেশিক ভারত থেকে যে সম্পদ ব্রিটেনে গেছে তা ব্রিটেনের জাতীয় আয়ের তুলনায় খুবই সামান্য, যা কিনা তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একমাত্র কারণ হবার পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয়। এবং শেষত ও সপ্তমত, ইউরোপে সপ্তদশ শতক থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রচণ্ড বৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তার মতিগতিতে ভারতে ঔপনিবেশিক দখলদারির সময়টুকুতে বা তার অব্যবহিত পরেও তেমন কোনও চোখে পড়ার মত তফাত দেখা যায় না, ফলে দুটো ঘটনার কার্যকারণ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই সেভাবে ওঠেনা।
এখন, এই সাতটি মোদ্দা কথা থেকে মোদ্দাতর কোনও কথা বেরিয়ে আসে কি? হ্যাঁ, তা আসে বোধহয়। কথাটা এই যে, ঔপনিবেশিক দখলদারিটা ইউরোপে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিকাশের একমাত্র কারণ হবার কথা ছিল না (মোদ্দা কথা নং ১-৬), এবং তা হয়ওনি (মোদ্দা কথা নং ৭)। বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও শিল্পবিপ্লবের মত সারা পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ঘোরানো প্রকাণ্ড ঘটনার পেছনে ভারতে ব্রিটিশের দখলদারির মত একটিমাত্র সংকীর্ণ কার্যকারণ খাড়া করা কিঞ্চিৎ ইতিহাসবোধরহিত। ত্রৈলোক্যনাথের গল্পে যেমন অন্ধকার জমে জমে ভূত হত, ঠিক তেমনি করে ঔপনিবেশিক শোষণ জমে জমে বোধহয় ইউরোপের বিজ্ঞানটা হয়নি। এমন কি শুধু ভারতকে না ধরে যদি আমেরিকা আফ্রিকা সহ সমস্ত উপনিবেশকেই হিসেবে নেওয়া যায় (সেক্ষেত্রে তুলনাটাও আর শুধু ব্রিটেনের সাথে হবে না, গোটা ইউরোপের সাথে হবে), তাহলেও আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আবির্ভাবকে স্রেফ ঔপনিবেশিক সম্পদ-পাচার দিয়ে বুঝে ফেলা যাবে না। বিষয়টা শুধু আধুনিক কালেরও নয়, এ আবির্ভাবের শিকড় রয়েছে ইউরোপীয় ইতিহাসের অনেক গভীরে।
কেউ বলতেই পারেন, কেন, প্রাচীনকালে বিজ্ঞান-সিদ্ধি তো শুধু গ্রিস-এরই ছিল না, ভারতেরও ছিল। আমি এ নিয়ে অবশ্যই খানিক তর্ক করতে পারি। বলতে পারি, এখানে থ্যালেসের মত করে বস্তুবাদী দর্শন আর বিজ্ঞান এক জায়গায় মেলেনি, অ্যারিস্টটলের মত করে তৎকালীন প্রাপ্তব্য সমস্ত জ্ঞান এক জায়গায় করে জবরদস্ত দার্শনিক কাঠামো-নির্মাণ হয়নি, আর্কিমিডিসের মত করে পদার্থবিদ্যা-গণিত-যন্ত্রবিদ্যার আঁটোসাঁটো তাত্ত্বিক সঙ্গমস্থল রচিত হয়নি, ইউক্লিডের মত করে প্রমাণতন্ত্রও জন্ম নেয়নি। আরও বলতে পারি, ভারতীয় পণ্ডিতরা ধাঁধার মত করে বিজ্ঞান বা গণিতের নিয়মগুলো ছড়ার আকারে লিখে রাখতে ভালবাসতেন, যাতে শিষ্যরা সেগুলো সহজে মুখস্থ করতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো কোথা থেকে কীভাবে এল সেই প্রমাণগুলো হাজির করতে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না।
কিন্তু, ধরুন, এ সব তর্কে গেলামই না। মেনে নিলাম, প্রাচীনকালে ভারত অন্যদের সাথে সমান সমান বা সামান্য এগিয়েই ছিল। ধরুন, এ নিয়েও কূট তর্ক করলাম না যে, ভারত আদৌ শূন্যের আবিষ্কারের কৃতিত্ব একা দাবি করতে পারে কিনা, চরক শুশ্রুতের চিকিৎসায় আদৌ রোগ সারত কিনা, বা, চতুর্দশ শতকের কেরালায় নীলকান্ত পণ্ডিত ইনইফাইনাইট সিরিজ বা অসীম শ্রেণির মত কিছু একটা পেলেই তাকে ‘ক্যালকুলাস আবিষ্কার’ বলে দাবি করা যায় কিনা। কিন্তু আমাকে বলুন তো, আধুনিক বিজ্ঞানের যা অগ্রদূত, সেই বৈজ্ঞানিক দর্শন কোথায়? বেকন-দেকার্তের কথা ছেড়েই দিলাম, একাদশ-দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের এক্সপেরিমেন্টাল ফিলোজফিই বা কোথায়? ইউরোপে মধ্যযুগের শেষের দিকে রজার বেকন, রবার্ট গ্রোসেটেস্টে, অ্যালবার্টাস ম্যাগনাস, উইলিয়াম অফ ওকাম, এঁরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্মাণের যে প্রাথমিক হদিশগুলো দিয়েছিলেন, সে সব কোথায় এখানে? প্রাচীন পৃথিবীর জ্ঞান আরব দেশ সংগ্রহ করল, আরবী-পার্শী ভাষায় তাকে অনুবাদ করে বাঁচিয়ে রাখল, বিকশিত করল, সেগুলো ল্যাটিন আর সিরীয় ভাষায় অনুবাদ হয়ে ইউরোপে গিয়ে সেখানে রেনেশাঁ ঘটিয়ে দিল, আর ভারতের পণ্ডিতরা কি তখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন? কষ্ট করে আরব, ইউরোপ আর চিনদেশে গিয়ে সেখানকার কাজগুলো সংস্কৃতে অনুবাদ করে আনলে মুসলমান আর সায়েব শাসকরা ফাঁসি দিয়ে দিত বুঝি?
শুধু বিজ্ঞানের কথাও তো নয়। ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞানই বা কোথায় এখানে? গ্রিক দার্শনিক জেনোফেনস যে খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকে সারা পৃথিবী ঘুরলেন, গ্রিক দেবতাদের সাথে আফ্রিকার দেবতাদের তুলনা করে দেখলেন, এবং বুঝলেন যে প্রত্যেক জায়গার মানুষ ঠিক নিজের মত করে তার দেবতাদের বানায় – ইউরোপের দেবতা হয় ফরসা ও চোখালো নাকওয়ালা, আফ্রিকার দেবতা হয় কালো আর পুরু ঠোঁটওয়ালা – সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের এই বোধ এখানে কবে জন্মালো? কোথায় এখানে হেরোডোটাস আর থুকিদিদিস-এর মত ইতিহাসবিদ? কেন বলুন তো, আমাদের দেশে কেউ কোনও ঘটনা লিখে রাখবেন না, নিজেদের ইতিহাস আমাদের অতিকষ্টে আন্দাজ করতে হবে পৌরাণিক দৈবী গালগল্প থেকে, বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ পড়ে আর রাজারাজড়াদের সম্পর্কে পেটোয়া লোকেদের লেখা খোসামোদী কাব্য পড়ে?
নাঃ, একজন অবিশেষজ্ঞ যুক্তিবাদী অ্যাক্টিভিস্ট-এর পক্ষে বড্ড বেশি কথা বলে ফেলছি বোধহয়, আর একদমই নয়। আমার বটমলাইনটা এই রকম থাক যে, মানুষের সভ্যতার উত্থান ও পতন ইতিহাসের নানা নৈর্ব্যক্তিক শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয়, তার কিছুটা আমরা বুঝি, কিছুটা আজও বুঝি না, তবে রোজই হয়ত আগের দিনের থেকে আরেকটু বেশি বুঝি। তার পেছনের কার্যকারণ কিছুটা ধারাবাহিক, কিছুটা আকস্মিক, কিছুটা আবিশ্ব, কিছুটা স্থানিক। কখনও মিশর-চিন-ব্যাবিলন-ভারত, কখনও গ্রিস, কখনও বাগদাদ, কখনও তুর্কি, কখনও ইটালি, কখনও ব্রিটেন, কখনও আমেরিকা এই সব উত্থান আর পতনের ধাত্রী হয়েছে। সব সময় সব সভ্যতাই সমসাময়িক ও আগের সভ্যতার থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছে (দক্ষিণ আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতাগুলোর কথা বাদ, তারা বেশ কিছুদূর গিয়েও বাকি পৃথিবীর সাথে আদানপ্রদানের অভাবে স্থাণু হয়ে গিয়েছিল)। এবং, সব সময়ে সব সভ্যতাই তার আগেরটির থেকে বেশি ‘গ্লোব্যাল’, বা বৈশ্বিক।
আমার কেমন যেন মনে হয়, ব্যাপারটা অনেকটা একটা হাঁড়িতে জল ফোটবার মত, এখানে ওখানে ফুটতে ফুটতে এক সময় গোটা হাঁড়ির জল একসাথে ফুটে ওঠা। জল ফুটে ওঠার প্রথম লক্ষণ যদি হাঁড়ির দক্ষিণ দিকে দেখা যায়, তার জন্য আমরা যেমন ‘ফুটে ওঠা’ ব্যাপারটাকেই ‘দক্ষিণী’ ঘটনা বলে আখ্যা দিতে পারিনা, ঠিক তেমনি আধুনিক বিজ্ঞানের বৈশ্বিক রূপটি প্রথম পশ্চিমে দেখা গেছে বলেই তাকে ‘পশ্চিমী’ আখ্যা দেওয়া যায় না – বিজ্ঞান সব সময়ই ‘ওয়ার্ল্ড ফেনোমেনন’, বৈশ্বিক ঘটনা। প্রথমদিকে এখানে ওখানে বিচ্ছিন্নভাবে বুদ্বুদ দেখা দিতে পারে, এক বুদবুদকে আত্মসাৎ করে আরেকটি বড় বুদ্বুদ জন্ম নিতে পারে, কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘ফুটে ওঠা’ ব্যাপারটা বোঝার জন্য এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল তাপের প্রবাহ ও জলের ধর্মের সাথে তার মোদ্দা সম্পর্কটা।
এটা ঠিকভাবে বুঝতে গেলে ইতিহাসকেও এক পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান হয়ে উঠতে হবে। হয়ত ভবিষ্যতের সমাজবিজ্ঞানীরা সেটা পারবেন, তাঁরা পরিসংখ্যানবিদ্যার উন্নত হাতিয়ার দিয়ে বিপুল তথ্য বিশ্লেষণ করে জটিল ঐতিহাসিক কার্যকারণের একেকটি স্বতন্ত্র উপাদানের গুরুত্ব আলাদাভাবে নির্ণয় করতে পারবেন, স্পষ্টভাবে তফাত করতে পারবেন ধারাবাহিকতা ও আকস্মিকতার মধ্যে, গড়তে পারবেন মানুষের ইতিহাসের দীর্ঘমেয়াদি গাণিতিক মডেল। কিন্তু, সে তো অনেক দূর ভবিষ্যতের কথা। যতদিন না তা পারা যাচ্ছে, ততদিন আমরা যেন অন্তত তথ্যযুক্তির প্রতি নিষ্ঠাবান থাকি, যেন চিরায়ত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে না ভুলি, যেন ইতিমধ্যে যেটুকু ভালভাবে জানতে পেরেছি তার সারাংশটুকু না হারিয়ে ফেলি। ঔপনিবেশিক অন্যায়কে অভিযুক্ত করতে হবে এ যদি বিজ্ঞানের ইতিহাসচর্চায় এক নৈতিক তাড়না হয়ে থাকে, তো তার বিপ্রতীপে একটি নৈতিক অবস্থান আছে আমারও। সে নৈতিকতা হল তথ্যযুক্তিজাত বস্তুনিষ্ঠ সত্যের প্রতি অনুগত থাকার নৈতিকতা, বৈশ্বিক মানুষের মোদ্দা ইতিহাসকে সংকীর্ণ ‘আমার ইতিহাস’-এ পর্যবসিত না করার নৈতিকতা, ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিকতাকে জাতীয়তাবাদী অভিমানের অনুগত হতে না দেবার নৈতিকতা। মানুষের ইতিহাস-চর্চার দৌড়ে অন্য সব কিছুকে পেছনে ফেলে এই নৈতিকতাই শেষপর্যন্ত সঙ্গে থাকবে, এই আমার বিশ্বাস।
মে ১০, ২০১৯; ১২:৪৩ অপরাহ্ন
ভাল লেখা। ধন্যবাদ।
//এখন, ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভারত দখল হবার আগে পর্যন্ত ইংরেজরা এ দেশে শুধুই ব্যবসা করেছে, সেখানে গা জোয়ারির প্রশ্ন ওঠে না ।//
আর্ধেক বললেন কিন্তু। ইংরেজরা আসার আগে, ১৭৫৭-র আড়াইশ বছর আগে থেকে পর্তুগিজ আর অন্যরাও গা জোয়ারি করেছে, সেটা হিসেবের খাতায় বাদ দেবার কারণ নেই। তবে পর্তুগিজরা এত লুটেপুটেও তেমন ফায়দা করতে পারেনি, এমন যুক্তি দিলে, ইংলিশ প্রাইভেটিয়ারদের কথাখান ভাববেন একটু। স্প্যানিশরা যা লুটপাট করত তার ওপর বাটপাড়ি করত ইংরেজরা। এই ধরুন রাণী এলিজাবেথ ১ এর আশির্বাদধন্য স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক। তিনি মূলত অতলান্তিকের পারে স্প্যানিশদের জাহাজ লুটতেন, কিন্তু ১৫৮৭-তে স্যান ফেলিপ বলে একখানি পর্তুগিজ জাহাজ তিনি লুটলেন, ব্যাস, গোয়া থেকে আনা সোনায় ভর্তি।
এরপরেও বলবেন, ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভারত দখল হবার আগে পর্যন্ত ইংরেজরা এ দেশে শুধুই ব্যবসা করেছে, সেখানে গা জোয়ারির প্রশ্ন ওঠে না?
মে ১০, ২০১৯; ১:১১ অপরাহ্ন
//এমন কি হতে পারেনা যে, হাজার সালের আগের পতনটা আকস্মিক, আর হাজার সাল থেকে এই যে অনবরত মসৃণ পতন, তার পেছনে বাস্তবিকই প্রথমে মুসলমান ও পরে ব্রিটিশদের লুণ্ঠনই দায়ী ? ব্যাপারটা এমন নয় তো যে, ‘ওরা’ এগিয়েছে আমাদের শোষণ করেই, তাই ওরা হয়েছে বড়লোক আর আমরা ক্রমেই হয়েছি গরিব ? সারণিটি (চিত্র-২) খুঁটিয়ে দেখলে সে প্রশ্নেরও অনেকটাই উত্তর পাওয়া যাবে — দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ স্তম্ভগুলোতে একটু নজর দেবেন । ভাল করে ভেবে দেখুন, আমাদের শোষণ করাটাই যদি অন্যদের উন্নতির একমাত্র কারণ হত, তাহলে ওরা বড়লোক হবার সাথে সাথে আমরা সমান তালে গরিব হতাম । অথচ স্পষ্টতই ঘটনা তা নয়, কারণ ওই সময়ে ক্রমাগতই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটেছে, খুব ধীর লয়ে হলেও । ওই সময়কালে উৎপাদনের মোদ্দা অর্থমূল্য (স্তম্ভ-২), মাথাপিছু আয় (স্তম্ভ-৩) এবং জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার (স্তম্ভ-৪) — এই তিনটি হিসেবেই ক্রমাগত সমৃদ্ধি ঘটেছে, নিজেদের অতীতের তুলনায় অন্তত আমরা গরিব হয়ে পড়িনি । প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যরা তবে সমৃদ্ধ হল কীভাবে ?//
উঁহু স্যার, ঠিক যুক্তি হলনাকো।
//ব্যাপারটা এমন নয় তো যে, ‘ওরা’ এগিয়েছে আমাদের শোষণ করেই, তাই ওরা হয়েছে বড়লোক আর আমরা ক্রমেই হয়েছি গরিব ?// কেন? ওরা আমাদের শোষণ করলেই আমাদের গরীব হয়ে যেতে হবে ক্রমাগত, এমন কে বলল?
১৫০০ সাল থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ভারতে মাথাপিছু আয় বেড়েছে খুব আস্তে আস্তে, জিডিপি-অ বেড়েছে কম হারে। বাকি পৃথিবীর জিডিপি বেড়েছে তুলনায় দ্রুত। ফলে বিশ্বে ভারতের জিডিপি-র অংশ কমেছে (অবশ্য ম্যাডিসনের ক্যালকুলেশন নিয়ে প্রশ্ন না করলে)। এটা কিছু রকেট সায়েন্স নয়। এর থেকে অন্য দেশ দ্বারা ভারতের ওপর শোষণ (ইয়ে, লুণ্ঠন বললে, খুব আপত্তি করবেন?) ছিল বা ছিল না এমনটা প্রমাণ করলেন কোন যুক্তিতে? আপনার মাইনের ইনক্রিমেন্ট হচ্ছে, আর আপনার কাছ থেকে ছিনতাই হচ্ছে নিয়মিত, আপনাকে গরীবতর হতেই হবে? যদি আপনার মাইনে ছিনতাইয়ের চেয়ে একটু বেশি হারে বাড়ে তো আপনার সামান্য উন্নতি হবে, কিন্তু ছিনতাইকারীরা আপনার চাইতে দ্রুত উন্নতি করবে, কেন না তাদের মাইনে বাড়ছে, প্লাস আপনার মাইনের একটা অংশ তাদের হাতে যাচ্ছে, সেটা দিয়ে পুলিশকে ঘুঁষ দিচ্ছে, আরও বেশি করে আপনার ওপর জোর করে আপনাকে ওভারটাইম করিয়ে আরও বেশি নিচ্ছে আপনার কাছ থেকে, কিন্তু আপনি গরীরতর হচ্ছেন না । এমন হতে পারে বিশ্বাস না হলে প্রোমোটার আর সিন্ডিকেটদের দেখুন।
//আমাদের শোষণ করাটাই যদি অন্যদের উন্নতির একমাত্র কারণ হত// — আরে আরে, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্রে অমন ব্যথা করবেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে “ইহার একমাত্র কারণ হইল উহা” বলবার দিন বহুদিন চলে গেছে। কেউ বলেনি আমাদের শোষণ করাটা অন্যদের উন্নতির একমাত্র কারণ। ঐ যে সিন্ডিকেট, তাদের উন্নতির কারণ কেবল প্রমোটারদের শোষণ করা, এমন নয়। (প্রমোটাররা খদ্দেরের কাছ থেকে পয়সা তুলে নেবে কিনা, কতটা নিতে পারবে, সেটা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাবেন না, প্লিজ)। কত রাস্তা আছে।ভোটে বোমা জোগানো, ভয় দেখানো, প্রভাব খাটিয়ে কন্ট্রাক্ট আদায়। ওসব করলেই কি আপনি বলবেন, প্রমোটারদের শোষণ করা পয়সাটা নেহাত শূন্য? ছিনতাইবাজ অন্যত্র খেটে খেলে, বা ডাকাতি করলে, আপনার ওপর ছিনতাই হয়নি?
মে ১০, ২০১৯; ১:২৩ অপরাহ্ন
//অনেকেই, এই রকম ‘কলোনিয়াল ড্রেন’ বা ঔপনিবেশিক সম্পদ-ক্ষরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন । অবশ্য, এই সম্পদের সবটাই পাচার হওয়া সম্ভব হত না, তার একটা বড় অংশ এখানেই লেগে যেত ঔপনিবেশিক পরিকাঠামো তৈরি ও যুদ্ধবিগ্রহে । //
ঔপনিবেশিক পরিকাঠামো তৈরি কথাটার মানে হল, আরও বেশি করে কীভাবে উপনিবেশ থেকে মাল হাতানো যায়। তা উপনিবেশ-ব্যবসার একটা ইনভেস্টমেন্ট। সেটাকে ‘কলোনিয়াল ড্রেন’-র থেকে আলাদা করে দেখা যেত যদি তা উপনিবেশের লোকেদের সাহায্য করত। কিন্তু তা সাহায্য করত মাল-হাতানেওয়ালাদেরই কেবল। যেমন রেলওয়ে। আর পরিকাঠামো তৈরির চেয়েও সহজভাবে বোঝা যায় যুদ্ধবিগ্রহে। যেখানে গোরা সৈনিকের বদলে গোর্খা সৈনিক দিয়ে সস্তায় পররাজ্যগ্রাস করা যায়। পররাজ্যগ্রাস করার পর আবার ইংরেজরা বিজিত রাজ্যের ওপর রিপারেশনের বোঝা চাপিয়ে দিত। এমনকি পররাজ্যগ্রাসের সময়ই যুদ্ধ চালানোর খরচ নেওয়া হতো, যেমন পলাশির পর নবাব তৈরির খেলার দাম দিত হোনেওয়ালা নবাবরা। এটা শুধু ড্রেন নয়, ড্রেন তৈরি করার সারচার্জও।
মে ১০, ২০১৯; ১:৪৭ অপরাহ্ন
//এই যে এত বিচিত্র সব সম্ভাব্য কারণ, এরই মধ্যে আরেকটি হচ্ছে, উপনিবেশ থেকে শোষণ করা সম্পদ ব্রিটেনে গিয়ে শিল্প-বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি যুগিয়েছিল — এই তত্ত্ব । বলা বাহুল্য, এটি একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে । উপনিবেশ থেকে সম্পদ যে বিদেশে পাচার হত, সে তো বলাই বাহুল্য ।//
বলা বাহুল্যই বটে!
“Compounding the Indian surpluses at 4 per cent, we obtain figures from 3,199,320 pounds to 3,779,264 pounds as the value of the surpluses taken by the British from South Asia, including Burma. Thus this surpluses alone would have financed anywhere between 75 to 95 per cent of the total British foreign investments.”
— Amiya Kumar Bagchi, Colonialism in Indian Subcontinent. OUP, Intro page xxxii
মে ১০, ২০১৯; ১:৪৯ অপরাহ্ন
“Currently, the understanding of Indian economic change during colonial times is being damaged, especially among scholars with no first-hand knowledge of Indian data, by apparently authoritative estimates of growth of GDP and per capita GDP produced by Maddison (1995, 2003). Maddison (2003: Table A3-c) puts the per capita income of India (in 1990 Geary-Khamis dollars) as 533 in 1820, 533 in 1870, and 673 in 1913. The implied growth in the estimated per capita income between 1870 and 1913 is totally without basis.”
— Amiya Kumar Bagchi, Colonialism in Indian Subcontinent. OUP, Intro page xxxiv
মে ১০, ২০১৯; ২:১০ অপরাহ্ন
//এই যে এত বিচিত্র সব সম্ভাব্য কারণ, এরই মধ্যে আরেকটি হচ্ছে, উপনিবেশ থেকে শোষণ করা সম্পদ ব্রিটেনে গিয়ে শিল্প-বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি যুগিয়েছিল — এই তত্ত্ব । বলা বাহুল্য, এটি একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে । উপনিবেশ থেকে সম্পদ যে বিদেশে পাচার হত, সে তো বলাই বাহুল্য ।//
আহা, কি অসাধারণ মহিমায় স্বীকৃতি পাচ্ছে উপনিবেশের অবদান। “একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে”!!
এর সঙ্গে যোগ করতে হবে,
//সেক্ষেত্রে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রেখাটি শোষণে নিম্নমুখী হয়ে পড়ার কথা, তা ঘটেনি । ভারতের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থেকেছে একই জায়গায়, এমন কি তার যৎসামান্য বৃদ্ধিও ঘটেছে, যদিও তা ইউরোপের তুলনায় খুবই নগণ্য।//
এর সঙ্গে যদি অনুগ্রহ করে এটাও যোগ করেন!
“This meant that 7.07 per cent of the gross domestic product of Bengal and Bihar was sent out of the country without any return. We should remember that the industrializing economy of England was not investing much more than 7 per cent of its GDP during precisely the decades that India was changing from an economy with a substantial share (ranging from 15 to 20 per cent) of the manufacturing sector in the GDP and employment of the economy to one in which the share fell well below 10 per cent over the course of the nineteenth century.”
— Amiya Kumar Bagchi, Colonialism in Indian Subcontinent. OUP, Intro page xxx
বাংলায় বললে, বাংলা বিহারের মোট জিডিপি-র [১৭৯৩-১৮০৭ সময়পর্বে] ৭.০৭% দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সেই সময় ইংল্যান্ড তার জিডিপি-র মোটামুটি ৭% দেশকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল করার জন্য খরচ করছিল। এ দেশে জিডিপি ও কর্মসংস্থান বিচারে মোট অর্থনীতির ১৫-২০% সেই সময়ের শুরুতে ছিল ম্যানুফাকচারিং সেক্টরে, সেটা ১০% -এরও নীচে নেমে গেল।
নাঃ, “একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে”-ই বটে!!
মে ১৭, ২০১৯; ১২:২২ অপরাহ্ন
জয়ন্ত, তোমার তোলা প্রশ্নগুলো আকর্ষণীয় । আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করব, তবে এই মুহূর্তে একটু ব্যস্ত আছি । সময় দাও, প্লিজ ।
মে ১৭, ২০১৯; ১২:২৩ অপরাহ্ন
সত্যি বলতে কী, প্রশ্নগুলো যে এখানে পোস্ট করেছ সে খবরটা কাল জানলাম সবে ।