১
৭০৩ বার পঠিত
Book cover: The Ministry of Utmost Happiness
প্রথম উপন্যাস লেখার দীর্ঘ বিশ বছর পরে বিখ্যাত লেখিকা অরূন্ধতী রায়ের দ্বিতীয় উপন্যাস বাজারে এসেছে, বইয়ের নাম ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’। গত কয়েক মাস যাবত মিডিয়ায় বইটি নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা চলছে। বিশেষত বুকার পুরষ্কার পাওয়া বই ‘গড অফ স্মল থিংস’ এর লেখিকা আবারো উপন্যাস লিখছেন এটা তাঁর পাঠকদের মধ্যে একটা আলাদা উত্তেজনা নিয়ে এসেছে। মাঝের দু’দশক অরূন্ধতী রায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতের হিন্দুত্ববাদী উত্থানের বিরূদ্ধে রাজনীতি ও সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। নতুন করে ফিকশান লেখার ব্যাপারে লেখিকার অভিমত, ‘Writing fiction is the closest thing to prayer’।
‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ বইয়ে তিনি সবার কথা বলতে চেয়েছেন। বইয়ের প্রধানতম চরিত্র আঞ্জুম, যেই কীনা আবার আফতাব, যে আসলে ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া কম্যুনিটির মানুষ। বইয়ের কাহিনী হিজড়াদের নিয়ে তা বলে বইটি হিজড়াদের সংগ্রামের মেনিফেস্টো নয়। যাই হোক আঞ্জুম বড় হলে পরিবার থেকে বেরিয়ে আসে ‘খোয়াবগাহ’ নামে নতুন একটা জায়গায় গিয়ে সমাজের আরো নিপীড়িত মানুষদের সাথে থাকা শুরু করে। তারা সবাই তার মত, আবার তাদের মধ্যে পার্থক্যও আছে। সে নিজে হিজড়া, কিন্তু সেখানে মুসলিম, হিন্দু, শিয়া, সুন্নী নানা মতবাদের মানুষ আছে যাদের অনেক সার্জারিতে বিশ্বাস করে না। তারা সবাই একসাথে থাকে, আর তাদের ডেরার বাহিরে আছে বিশাল ‘দুনিয়া’ যার থেকে তারা আলাদা, বিতাড়িত।
বইটিতে সীমা অতিক্রমণ করা, ‘বাউন্ডারি ক্রসিং’ একটা মূলভাব হিসেবে এসেছে, বেশিরভাগ চরিত্র কোন না কোন সীমাবন্ধনমুক্ত। এসব সীমারেখার মধ্যে আছে পবিত্র এবং অশ্রদ্ধ, ধর্ম-অধর্ম, জীবন-মৃত্যু, পার্থিব এবং দৈব, পুরুষ এবং নারী, দেশ-বিদেশ। আঞ্জুম যেমন পুরুষ আর নারীর সীমারেখার মধ্যে বাস করে, অন্য সব চরিত্রও তেমনি নানান সীমারেখার মধ্যে। আঞ্জুমের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন হলো ‘দলিত’ সম্প্রদায়ের মানুষ, যার চোখের সামনে হিন্দুত্ববাদীরা তার বাবা-মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। চগরুর মৃতদেহ বহন করার কারণে গোরক্ষা কমিটির মানুষেরা তার বাবাকে মেরে ফেলে। যার ফলে সে দলিত হিন্দু থেকে মুসলমান হয়ে যায় এবং নিজেকে সাদ্দাম বলে ডাকে। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসির ভিডিও দেখে সে মারাত্মকভাবে অভিভূত হয়ে নিজেকে সাদ্দাম ডাকা শুরু করে। সাদ্দাম বর্ণপ্রথা আর ধর্মীয় সীমারেখার মধ্যে বাস করে।
বইয়ের আরেকটি প্রধান চরিত্রের নাম তিলোত্তমা, দক্ষিণের মেয়ে, ভারতীয় প্রথায় সেও নামগোত্রহীন জায়গা থেকে উঠে আসা। তারপরে আছে মূসা, যে কীনা কাশ্মীরী, ভারতের সাথে যুদ্ধরত, জাতীয় সীমারেখায় যার বসবাস। অরূন্ধতী রায় কাশ্মীরীদের ব্যাপারে বরাবরই সোচ্চার, তাই এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে তার লেখায় কাশ্মীর উঠে আসবে। এক সাক্ষাৎকারে অরূন্ধতী রায় বলেছেন, কাশ্মীরীরা গত পঁচিশ বছর ধরে ‘under the densest military occupation in the world’ এ বসবাস করছে।
বইয়ের পটভূমির মূল কেন্দ্র হলো দিল্লীর ‘যন্তর মন্তর’ বলে একটা জায়গা যেখানে সমাজের যত বঞ্চিত-লাঞ্চিত মানুষেরা যাবতীয় সব প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হয়। ব্যাপক পুলিসি তৎপরতার কারণে জায়গাটা এখন আর আগের মত নেই। এখানে অরুন্ধতী রায় নিজে অনেক সময় কাটিয়েছেন। কাহিনীর এক পর্যায়ে সেখানে একটা বাচ্চা এসে হাজির হয় কেউ জানে না বাচ্চাটি কার কোথা থেকে এসেছে। রাজনীতি, আন্দোলন, সংগ্রামের মাঝে এসে মেয়ে শিশুটা হাজির হয়, কেউ জানে না তাকে নিয়ে কী করবে। লেখিকার কাছ থেকে জানা যায়, এরকম ঘটনা নাকী তার জীবনে সত্যিই ঘটেছিল।
এ ঘটনা থেকে কাহিনী নানা ডাল-পালা মেলে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শিশুটা কাহিনীতে হাজির হয়, হারিয়ে যায়, আবার আসে। আঞ্জুম কবরস্থানে ‘জান্নাত’ নামে একটা বাসস্থান গড়ে, সেখানে সাদ্দাম তার সাথে থাকে। কবরও এখানে জীবন আর মৃত্যুর সীমারেখার রূপক, ফলে বইটা সীমারেখা অতিক্রমণ এবং এর মাঝে বসবাসের উপরে লেখা। আদিম দেবতারা সীমারেখা লংঘন করত, সমাজের নিম্নবৃত্তের নিপীড়িত এ মানুষগুলো যাদের কোথাও ঠাঁই হয় না, তারাও দেবতাদের মত অনবরত সীমা অতিক্রমণ করে যায় আর তাদের নিয়েই এ গল্প। লেখিকার ভাষায়,
“All these stories somehow are about people who just don’t fit into that grid and who eventually create a little community, and a kind of solidarity emerges, which is a solidarity of the heart.”
Book cover: God of Small things
পাঠকেরা বইটি কীভাবে নিবে সেটা দেখা যাবে। কিন্তু এ বই লেখিকার আগের উপন্যাস ‘গড অফ স্মল থিংস’ এর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সেটা বুঝা যাচ্ছে। লেখিকা স্বীকার করেছেন, তিলোত্তমার সাথে আগের উপন্যাসে এস্থা আর রেহেলের সম্পর্ক আছে। তারপরেও এ বইটি ভিন্ন ধরনের, এ বই লেখিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে উৎসারিত। এতে এক্টিভিস্ট হিসেবে তাঁর দু’দশকের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। ভারতীয় সমাজে আজকে যারা নির্যাতিত, নিপীড়িত, দলিত, মুসলিম, সমকামী, হিজড়া এদের সবাইকে নিয়ে লেখিকা গল্প ফেঁদেছেন, যেটা মধ্যবিত্ত পাঠককে নাড়া দিবে বলে আমার বিশ্বাস। লেখকের কাজও সেটাই, চিত্তরঞ্জনের সাথে সাথে পাঠককে তার ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বের করে এনে তার মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করা। আমার মনে হয়, লেখিকা তাতে সফল হয়েছেন।
[ নোট: কপিরাইট আইনের জটিলতার কারণে আপাতত বইটির পিডিএফ ভার্সন আপলোড করা সম্ভব হলো না। আইনগত ঝামেলা না হলে বইটির ডাউনলোড লিংক সহজলভ্য হলে পরবর্তীতে আপলোড করা হতে পারে। ]
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৭; ৯:১১ পূর্বাহ্ন
ভারতীয় কায়দায় একটি ঢোলাঢালা জামা পরে অনুষ্ঠানটিতে এসেছিলেন অরুন্ধতী রায়। ১৯ জুন ২০১৭। নিউইয়র্কের ব্রুকলিন একাডেমি অব মিউজিকের অপেরা হাউসের চারতলার প্রায় শেষের দিকে একটি আসনে স্থান হয়েছিল আমার। হাজার দুয়েক দর্শক—অধিকাংশই নারী—প্রায় সবার হাতে অরুন্ধতী রায়ের নতুন উপন্যাস দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস। অরুন্ধতীকে মনে হলো কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত ও বিব্রত, ‘কী বলব, তার চেয়ে বরং আমার বই থেকেই পড়ে শোনাই’, খুব নিম্নকণ্ঠে কথাগুলো বলে হাতের বইটি মেলে ধরলেন।
তাঁর প্রথম উপন্যাস দ্য গড অব স্মল থিংস প্রকাশিত হওয়ার পর ২০ বছর কেটে গেছে। অরুন্ধতী জানিয়েছিলেন, তিনি আর ‘ফিকশন’ লিখবেন না, যা বলার এক বইতে বলে ফেলেছেন। সেই বইটি ছিল একটি নিষিদ্ধ প্রেমের অপূর্ব মন্থন। অভাবিত কাব্যময় ভাষায় একটি পারিবারিক ট্র্যাজেডির সংগোপন প্রকাশ। পরবর্তী ২০ বছর অরুন্ধতী যে নীরব ছিলেন, তা নয়। এই সময় সাহিত্য ছেড়ে তিনি বেছে নেন ‘প্রতিবাদ রাজনীতি’, জড়িয়ে পড়েন ভারত সরকারের নিগ্রহ নীতির বিরোধিতায়। যুক্ত হন মাওবাদীদের সঙ্গে। ভূমিহীন-দলিতদের সঙ্গে। এমনকি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষেও কথা বলেছেন তিনি। ভারতের পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একদিকে সরকার, অন্যদিকে বৃহৎ পুঁজির কোপানলে পড়েন অরুন্ধতী। ইরাক যুদ্ধ এবং বিশ্বজুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও তিনি হয়ে ওঠেন এক প্রধান সমালোচক। ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগে নিউইয়র্কের কুপার ইউনিয়নে তাঁকে দেখেছি কয়েক হাজার মানুষের সামনে ওই যুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদী চরিত্র তুলে ধরতে।
অন্য কথায়, অরুন্ধতী কথাসাহিত্যিক থেকে পরিণত হলেন ‘এজেন্ট প্রভোকেটিওর’-এ। দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস-এর পাঠ শেষে আলাপচারিতা শুরু হতেই প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হলো তাঁকে, সাহিত্যিক যখন রাজনীতিক হয়ে ওঠেন, তা কি সাহিত্যের জন্য দুঃসংবাদ নয়? হেসে উঠলেন অরুন্ধতী, ‘লেখক যদি তাঁর সমাজ নিয়ে না লেখেন—যে সমাজ অসাম্য, বিভক্তি ও নিবর্তনে জর্জরিত—তাহলে অন্য আর কী নিয়ে তিনি লিখবেন? আর এর নাম যদি রাজনীতি হয়, তাহলে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’ আরেকজন প্রশ্ন করলেন, ‘কেউ কেউ বলে, আপনি বড় নাটুকে, বড্ড হিস্টেরিক্যাল (আবেগপ্রবণ)।’ এবার হাত দুটো ঊর্ধ্বে ছুড়ে অরুন্ধতী বললেন, ‘এখানে এমন কোনো নারী আছেন কি যাঁকে কখনো না কখনো এই সব অভিযোগ শুনতে হয়নি?’ সারা অপেরা হাউসের দর্শকেরা সোল্লাসে সমর্থন জানাল তাঁকে।
এত দীর্ঘ সময় উপন্যাস লেখেননি কেন? আরেকজনের প্রশ্ন। অরুন্ধতী জানালেন নিম্নকণ্ঠে, ‘উপন্যাস লেখা কঠিন কাজ। এর জন্য সময় চাই।’
এক দশকের বেশি সময় ধরে অরুন্ধতী রায় তাঁর এই দ্বিতীয় উপন্যাসটি নিয়ে ভেবেছেন, অল্প অল্প করে লিখেছেন। বস্তুত, তাঁর কথায়, ‘৩৭ বছর ধরেই বইটি আমি লিখছি।’ এই কথার অর্থ, অনুমান করি, পরিণত বয়সের প্রায় পুরোটা সময়ই এ রকম একটি উপন্যাস লেখার জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। তিনি যে জীবন দেখেছেন এবং যে জীবনাভিজ্ঞতা তাঁকে আলোড়িত করেছে, নিজের উপন্যাসের রসদ সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন। অরুন্ধতীর প্রথম উপন্যাসটি ছিল একটি ব্যক্তিগত কাহিনি, একটি পরিবারের গোপন লজ্জার ভেতরের গল্প। কিন্তু দ্বিতীয় উপন্যাসে তিনি বিবেচ্য বিষয় নির্ধারণ করেছেন নাগরিক বলয় থেকে। দুটি সমান্তরাল গল্প—একদিকে দিল্লির একটি ‘হিজড়া’ মেয়ে আনজুমের আত্ম-আবিষ্কার, অন্যদিকে স্থাপত্যকলার ছাত্রী তিলোত্তমা ও পুলিশি নখর থেকে পালিয়ে বেড়ানো তার কাশ্মীরি প্রেমিকের কাহিনি। এই দুই কাহিনির নকশিকাঁথা থেকে আধুনিক ভারতের বিষাদগাথা নির্মাণ করেছেন অরুন্ধতী, যেখানে নারী তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত, নিম্নবর্ণের মানুষ সমাজের প্রান্তসীমায় বাস করে, মুসলমানদের দিন কাটাতে হয় অবিশ্বাসে, অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইরত যুবককে পালিয়ে বেড়াতে হয় পুলিশ ও সামাজের রক্তচক্ষু থেকে। এই দুইয়ের মধ্যে ভেদরেখা নির্ধারণ অসম্ভব। বস্তুত, অরুন্ধতীর এই উপন্যাস আধুনিক ভারতের এক বর্ণাঢ্য মানচিত্র। এখানে রয়েছে গুজরাটের দাঙ্গা, ভূপালের গ্যাস বিস্ফোরণ, দিল্লির যন্তরমন্তরে ছাত্র বিক্ষোভ। এই ভারত প্রবল রকম সামন্ততান্ত্রিক, শ্রেণিবিভক্ত, দুর্নীতিনির্ভর ও নিবর্তনবাদী। ধর্মের নামে এখানে ক্ষমতা দখল করা যায়। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উচ্চকণ্ঠ অন্য সব কণ্ঠস্বরকে তলিয়ে দিতে পারে। আবার এই দুঃসহ ও দুর্মর মানচিত্রের ভেতর পাতায় বাস করে ভালোবাসা, সেখানে আশ্রয় পায় প্রেম, জন্ম নেয় আশা।
এক কথায়, অপূর্ব!
অরুন্ধতী এই ভারতের বিরুদ্ধে এবং এক ভিন্ন ভারতের জন্য লড়াই করছেন গত আড়াই দশক। এ জন্য তাঁকে পুলিশি জুলুম সহ্য করতে হয়েছে, জেলের ঘানি টানতে হয়েছে। বলা যায় দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস তাঁর সে লড়াইয়েরই গল্প। তিলোত্তমা নামের মেয়েটি, যে প্রশিক্ষণে অরুন্ধতীর মতো একজন স্থপতি—সে স্পষ্টতই লেখকের নিজের আদলে নির্মিত। যে ভারতের কাহিনি লিখতে চান অরুন্ধতী, সেখানে ব্যক্তিগত ও সামাজিক—এই দুইয়ের মধ্যে ভেদরেখা নির্ণয় যে অসম্ভব, উপন্যাসের প্রথম পাতা থেকেই সে কথা তিনি খোলাসা করে দেন:
‘গোধূলি প্রহরে, যখন সূর্য অস্তমিত হয়েছে কিন্তু তার আভা তখনো বদলায়নি, ঠিক সে সময় পুরোনো কবরখানার বুড়ো বটগাছ থেকে এক এক করে নামতে থাকে বাদুড়ের দল। তারা ধোঁয়ার মতো ভাসতে থাকে। বাদুড় চলে গেলে ঘরে ফেরে কাকের দল। তাদের গৃহে ফেরার হুটোপুটিতে অবশ্য বাদুড়ের অথবা সাদা-পিঠ শকুনের ফেলে যাওয়া নৈঃশব্দ্য পূর্ণ হয় না। লক্ষ-কোটি বছর ধরে এই সব শকুনের দল মৃতদের পাহারাদারের কাজ করেছে, ডিক্লোফেনাকের রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় এখন তারা সব মৃত। ডিক্লোফেনাক নামের এই এসপিরিন গরুদের খেতে দেওয়া হয় একদিকে তাদের পেশির বেদনা উপশমে, অন্যদিকে দুধের উৎপাদন বাড়াতে। এই ওষুধ শকুনের ওপর কাজ করে ঠিক নার্ভ গ্যাসের মতো। ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মৃত প্রতিটি গরু বা মোষ বিষাক্ত টোপ হয়ে ধরা দেয় শকুনের কাছে। গরু ক্রমশ হয়ে ওঠে দুধের কারখানা। সেখান থেকে শহুরে মানুষের জন্য তৈরি হয়ে আসে আরও বেশি বেশি আইসক্রিম, মজাদার ননি ও চকলেটমাখা বিস্কুট। আসে আমের মিল্কশেক। শকুনের গ্রীবা দীর্ঘ হয়ে ঢলে পড়ে, যেন তারা ভীষণ ক্লান্ত, জেগে থাকা অসম্ভব। তাদের ঠোঁট থেকে গলে পড়ে লালা, আর তারপর এক এক করে তারা গাছের ডাল থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, মৃত।’
যে ক্লান্ত, বিষাদময় ও সন্ত্রাসে ভরা কাহিনি লিখতে বসেছেন অরুন্ধতী, এ তার উপক্রমণিকা মাত্র। এই এক অনুচ্ছেদেই তিনি আমাদের আধুনিক ভারতের যন্ত্রণাময় বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত করাচ্ছেন। সতর্ক করিয়ে দিচ্ছেন যে সেখানে রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদক বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী পুঁজির শিকার শুধু অসহায় গবাদিপশু, বাদুড় ও শকুন নয়, সাধারণ মানুষও। অরুন্ধতী যখন বলেন সমাজ ও রাজনীতি অভিন্ন নয়—সাহিত্যে তার প্রকাশ সে কারণেই অনিবার্য, এই এক অনুচ্ছেদেই সেই কথার যৌক্তিক ভিত্তি রচিত হয়ে যায়।
কোনো লেখক কঠিন বাস্তবের রূঢ় চিত্র এড়িয়ে বেশ আলাভোলা নিটোল গল্প ফাঁদতে পারেন, সেটি হবে ওই লেখকের লেখক হিসেবে নিজের দায়িত্ব থেকে পলায়ন। রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি একসময় তাঁর এক অগ্রজ লেখককে এই বলে তিরস্কার করেছিলেন, মানুষ রাস্তায় গুলিতে মারা যাচ্ছে, আর আপনি নিজের ব্যক্তিগত শোক-দুঃখের গল্প লেখায় ব্যস্ত! নিঃসন্দেহে অরুন্ধতী সেই দলভুক্ত লেখক নন। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁর কাজ ছিল ক্ষমতাহীন ও দুর্বল মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা। তাদের সঙ্গে সংহতি নির্মাণ।
এই উপন্যাসে ঠিক সেই কাজটিই করেছেন তিনি। পৃথিবীর সেরা লেখকেরা সব সময়ই এই কাজটি করেছেন—তাঁরা মানুষের কথা বলেছেন, মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গে সংহতির বিবৃতি নির্মাণ করেছেন। পরিবর্তনের সম্ভবনায় আস্থা জাগিয়েছেন মানুষের মনে।
তবে অন্য অনেকের সঙ্গে অরুন্ধতী রায়ের প্রভেদ এখানে যে তিনি কেবল কথা বলেই নিজের কাজ শেষ করেননি, মাঠেও নেমে এসেছেন। যাঁরা লড়াই করেন, যাঁরা ব্যারিকেডে দাঁড়ান, তাঁদের সঙ্গে এক কাতারবদ্ধ হয়েছেন। একজন আধুনিক লেখককে যদি সৎ থাকতে হয়, তাহলে পথে নামা ছাড়া তাঁর সম্ভবত অন্য কোনো পথ নেই।
অজানা তথ্য
দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস
১. শিরোনাম
দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস—অরুন্ধতী রায়ের দ্বিতীয় উপন্যাসের কেন এই নাম? কী এই শিরোনামের তাৎপর্য? এ নিয়ে ঔপন্যাসিকের ভাষ্য হলো, মানুষ যে সব সময় তার প্রত্যাশিত জায়গাগুলো থেকেই আনন্দ পেয়ে থাকে, সব ক্ষেত্রে এটি ঠিক নয়। অনেক সময় অনেক অপ্রত্যাশিত জায়গাও মানুষকে আনন্দ দেয়। এমন একটি ধারণাই দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস উপন্যাসের শিরোনামের প্রধান তাৎপর্য।
২. প্রচ্ছদ
উপন্যাসের প্রচ্ছদের জন্য অরুন্ধতীর অনুরোধে আলোকচিত্রী মায়াঙ্ক অসটিন সুফি দিল্লির পুরোনো একটি সমাধিক্ষেত্রের কিছু ছবি তুলে পাঠান তাঁকে। সেসব ছবির কয়েকটি তিনি দেন ডিজাইনার ডেভিড এলড্রিজের কাছে। এরপর ওই ছবির সঙ্গে ডেভিড তাঁর নিজের পছন্দের কিছু সমাধিক্ষেত্রের ছবির মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেন বইয়ের প্রচ্ছদ। ডেভিডের মতে, ‘প্রচ্ছদটি কাছ থেকে দেখলে একরকম অনুভূতি হয়, আবার একটু দূরে সরালেই মনে হয় অন্য রকম।’ আর অরুন্ধতী বলেছেন, ‘ক্ষয়িষ্ণুতারও যে একটি সৌন্দর্য আছে, প্রচ্ছদ দেখলে তা বোঝা যায়।’
৩. চরিত্র
মোট ৪০টি চরিত্র আছে উপন্যাসে। চরিত্র প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিকের কথা, ‘সবগুলো চরিত্র নিয়েই আমার পথচলা।’
৪. গল্প
‘বিক্ষিপ্ত জীবনের খণ্ড খণ্ড কিছু গল্প বলেছি আমি। এসবের মধ্যে দৃশ্যত কোনো সংযোগ নেই। আবার গভীরভাবে ভাবলে অনেক সংযোগ আছে।’ দ্বিতীয় উপন্যাসের গল্প সম্পর্কে অরুন্ধতীর ভাবনা এমন। তবে এটি কেবল রাজনৈতিক উপন্যাস—এ কথা মানতে তিনি নারাজ। তাঁর মতে, ‘সবকিছুই রাজনৈতিক। এমনকি একটি গোল্ডফিশের যৌনজীবনও রাজনৈতিক। আমার এই উপন্যাসের পরতে পরতে রাজনীতির আবহ আছে। তাই একে আলাদা করে রাজনৈতিক উপন্যাস বলার প্রয়োজন নেই।’ উল্লেখ্য, উপন্যাসটিতে এসেছে ২০০২ সালে গুজরাটের মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও কাশ্মীর প্রসঙ্গ।
৫. কাশ্মীরের কথা
সমসাময়িক কাশ্মীরের ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে উপন্যাসে। এটি লেখার জন্য অনেকবার কাশ্মীরে গিয়েছেন অরুন্ধতী। সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশেছেন নিবিড়ভাবে। কাশ্মীরে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে তাঁর। তাঁর ভাষায়, ‘যুদ্ধপীড়িত কাশ্মীরের বাতাসও যে সংঘাতের কথা বলে, তা বলতে চেয়েছি এই উপন্যাসে।’
৬. প্রকাশ
দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস লেখার পর আরেকবার না পড়েই সরাসরি প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দেন অরুন্ধতী। তাঁর ভাষ্য, ‘ফিকশন লেখার বেলায় অবচেতন মনের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস রাখি আমি। তাই বারবার পড়ার প্রয়োজন হয় না।’ উপন্যাসটি একসঙ্গে ৩০টি দেশে ২৬ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
৭. উপন্যাস লেখায় বিরতি কেন?
দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস লিখতে ইচ্ছাকৃতভাবে এতটা সময় নেননি অরুন্ধতী রায়। তিনি মনে করেন, ফিকশন নিজেই নিজেকে গোছাতে ক্ষেত্রবিশেষে বেশি সময় নেয়। ফলে লেখক বলেন, এই উপন্যাস লিখতে বেশি সময় লাগেনি। সময় যা লেগেছে তা ঠিকই আছে। এটি লিখতে ২০ বছর সময় লেগেছে—এ তথ্যও পুরোপুরি ঠিক নয়। মূলত ১০ বছর ধরে উপন্যাসের গল্পগুলো দানা বেঁধেছে লেখকের ভেতরে।
সূত্র: ডেমোক্রেসি নাও ডট ওআরজি, দ্য আটলান্টিক ডট কম, পেঙ্গুইন ইউকে ডট কম, দ্য স্লেট ডট কমে প্রকাশিত অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকার এবং দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত ডেকা এইটকেনহেডের প্রবন্ধ।