বিগত শতাব্দীর ছয়-সাতের দশকে ভারতবর্ষের এই বাংলায়, পরবর্তীতে সমগ্র দেশজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের শোষণের শেকল ছেঁড়ার এক অভাবিত মুক্তি-সংগ্রাম শুরু হয়েছিল।ভারত-নেপাল সীমান্তে, শিলিগুড়ি মহকুমার এক অখ্যাত গ্রাম নকশালবাড়ির বিপ্লব স্পন্দিত রণভূমিতে মাথা তুলেছিলেন ৬০ হাজার কৃষক- শোষণ, শাসন, অনাহার, অত্যাচার, অমর্যাদার শতাব্দীপ্রাচীন স্থবিরতাকে চূর্ণ করে শ্রমিক-কৃষকের রাজ প্রতিষ্ঠা করতে। শ্রেণি সংগ্রাম জন্ম দিয়েছিল এই গভীর প্রত্যয়ের যে কণ্ঠরোধী নির্মম সামন্তশোষণ এবং আধা-উপনিবেশ ভারতের মুৎসুদ্দি পুঁজি পরিচালিত উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিষ্ঠানগুলিকে শুধুমাত্র প্রত্যাখ্যান নয়, বরং তার ভিত উপড়ে ফেলে শোষণমুক্ত স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, মানবিক সমাজ নির্মাণের। জন্ম হয়েছিল এক অবিনাশী মুক্তছন্দের- যার অনুরণনে প্রাণিত শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুব-মধ্যমবর্গের এক ব্যাপক অংশ সশস্ত্রতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আত্মদানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।যা বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ নামে খ্যাত,যা নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যত্থান নামে সুবিদিত। আজ সেই ২৫শে মে নকশালবাড়ি দিবস। বারে বারে ফিরে আসে এই দিনটি সংগ্রামের এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হয়ে।
সি পি আই (এম এল )- এর ঐতিহাসিক শিকড়
‘আমাদের মনে রাখতে হবে,ভারতবর্ষের বিপলবী জনতা কমিউনিস্ট আন্দোলনে বার বার সংগ্রাম করেছেন,অসীম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন,জীবন দিয়েছেন। পুন্নাপ্রা -ভায়ালার প্রদেশের শ্রমিক ও কৃষক সংগ্রামীরা বহু জীবন দান করে যে ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যেতে হবে আমাদের,আমরা তারই উত্তরসাধক।যে কমিউনিস্ট পার্টির নাম করে কায়ুরের বীরেরা ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন,সেই কমিউনিস্ট পার্টি আজকের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। সেই মহান অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলন করা এবং ভুল চিন্তাগুলির বিরুদ্ধে তীব্রতম শ্রেণিঘৃণার সৃষ্টি করা।
কমরেডগণ, মনে রাখবেন ভারতবর্ষে কৃষক জনতা বার বার সংগ্রাম করেছে,বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে,বহু শহীদের দেশ এই ভারতবর্ষ। … ভারতবর্ষের বিপলবী কৃষককে,দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষককে শ্রদ্ধা করতে শিখুন; তাদের উপর ভরসা রাখলে কোনোদিন পথের ভুল হবে না।’
*(সংগ্রহ-” ভারতের বিপলবী কৃষক সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলন করে এগিয়ে চলুন” চারু মজুমদার,—- লিবারেশন,ডিসেম্বর ১৯৬৯)
চারু মজুমদার ১৯৭২ সালে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেদের হাতে ধরা পড়ার কয়েকদিন আগে একটি লেখা লিখেন,জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ এই শিরোনামে –“আজ আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ব্যাপক মূল জনগণের মধ্যে পার্টি গঠন করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং লড়াইয়ের ভিত্তিতে জনগণের ব্যাপকতম অংশের সাথে যুক্তমোর্চা প্রতিষ্ঠা করা। কংগ্রেস রাজত্বের বিরুদ্ধে ব্যাপকতম যুক্তমোর্চা প্রতিষ্ঠা করা যায়।আজ বামপন্থী দলগুলি সাধারণ মানুষের প্রতি যে অত্যাচার কংগ্রেস চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেতৃত্ব দিচ্ছে না।সেই সব দলগুলীর মধ্যকার শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণের তাদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ রয়েছে।ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ভিত্তিতে আমাদের তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।এমন কি যারা আমাদের প্রতি শত্রুতা করেছে বিশেষ পরিস্থিতিতে তারাও আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে এগিয়ে আসবে।এই সব শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মতো মনের প্রসারতা রাখতে হবে।মনের প্রসারতা কমিউনিস্টদের গুন।জনগণের স্বার্থই আজ ঐক্য বদ্ধ সংগ্রামের দাবি ,জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ।”
নকশালবাড়ির আত্মদর্শন
আমরা যদি নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের প্রধান পদক্ষেপগুলি এবং তাদের সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতার দিকে তাকাই। কিছু বিষয় সহজেই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। নকশালবাড়ী একটি কৃষক বিদ্রোহ ছিল যা অত্যাচারিত ভূমিহীন দরিদ্রের যন্ত্রণা ও ক্রোধকে শক্তিশালী প্রতিরোধে পরিণত করেছিল।আজকের কৃষি সংকটের সামনে স্পষ্টরূপে নকশালবাড়ির বার্তা অনুরণিত হচ্ছে।
নকশালবাড়ি আমূল পরিবর্তনকামী তরুণদের উত্থান যেখানে ,আন্দোলনে ছাত্র ছাত্রীদের ভূমিকা,তাদের অংশগ্রহণের তীব্রতা ,তাদের আত্মত্যাগ স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা ছাত্রছাত্রী দের ভূমিকার সঙ্গে তুলনীয়। হাজার হাজার শহুরে ছাত্র-ছাত্রী আমূল পরিবর্তনকামী বিপ্লবী রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল –তারা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল সেখানকার শোষিত দরিদ্র জনগণের সঙ্গে একত্রিত হতে ,এবং তারা দেশপ্রেমকে এক নতুন ভাষায় পরিচিত করেছিল,”People first” যার মর্মার্থ “প্রথমে মানুষ তারপরে সব।
নকশালবাড়ির প্রকৃত তাৎপর্য
“ নকশালবাড়ির অর্থ বুনিয়াদী জনগণের জাগরণ। সশস্ত্র কিছু স্কোয়ার্ড দিয়ে এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত কিছু কার্যকলাপ বা কিডন্যাপের মতো চমকপ্রদ একশান করে বেড়ানো নয়।তার অর্থ কলকাতা,দিল্লী, বোম্বেতে কফি হাউসে বসে বড় বড় বিপলবী বুলি আওড়ানোও নয়। নিজেদের ব্যর্থতাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী আমাদের যত গালাগাল দিয়ে বেড়াক না কেন, সত্য এটাই যে নকশালবাড়ির ধারায় এই কৃষক জাগরণ একমাত্র ঘটেছে বিহারেই এবং আমাদের পার্টিই রয়েছে তার সামনের সারিতে। নকশালবাড়ির অর্থ এই কৃষক জনগণের ভিত্তিতে জাতীয় রাজনীতিতে এক বৈপলবিক রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন।স্থানীয় ভিত্তিতে কৃষকের কিছু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া পূরণের মানেই কিন্তু নকশালবাড়ি নয়।পাহাড়ে জঙ্গলে গিয়ে ‘লাল সেনা ও ঘাঁটি এলাকা’ গড়ে যারা বিকল্প রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তাদের সকলেই ব্যর্থ হয়েছেন। এখন সেখানে রাজনীতি বন্দুক চালাচ্ছে না উল্টে বন্দুকই রাজনীতি চালাচ্ছে।
নকশালবাড়ি মার্কসবাদ বনাম সংশোধনবাদ,সশস্ত্র সংগ্রাম বনাম সংসদীয় পথের মধ্যকার সংগ্রাম কোনো বিমূর্ত সংগ্রামের সাফল্য নয়। পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদ কিন্তু তাই ভাবে।কাজেই সে মনে করে বিপলবী ভাবাবেগ দিয়ে ও কিছু মৌলিক মার্কসবাদী সূত্র দিয়ে যখন খুশি,যেখানে খুশি নকশাবাড়ি গড়ে তোলা সম্ভব। যাবতীয় নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ,তদজনিত হতাশা এবং অবশেষে উল্টো পথে যাত্রা – যার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে — এসবের পিছনে বিপলব সম্পর্কে মধ্যবিত্তের সেই কল্পনাবিলাসই কাজ করে।।
নকশালবাড়ির শিকড় রয়েছে ভারতের গ্রামীণ সমজব্যবস্থার অন্তরদ্বন্দ্বের মধ্যে,তার পেছনে আছে দীর্ঘ কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস, তেভাগা-তেলেঙ্গানার ধারাবাহিকতা।আছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই বিপরীতমুখী কৌশলগত লাইনের মধ্যকার দীর্ঘ সংগ্রামের প্রক্রিয়া।একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যার পরিণতি ঘটেছিল নকশালবাড়ির বিদ্রোহে।নকশালবাড়িকে বুঝতে হলে এসবই বুঝতে হবে। মেহনতি কৃষক জনগণের জাগরণের মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা হবে নাকি বুর্জোয়াদের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্তফ্রন্টের স্বার্থে কৃষক জনগণের উদ্যোগকে স্থিমিত করা হবে — এই দুই বিপরীতমুখী কৌশলের লড়াই দীর্ঘ সময় ধরে পার্টিতে চলেছিল।১৯৬৭ সালের বিশেষ এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই এই লড়াই চরম বিন্দুতে পৌঁছায় – যখন ক্ষমতাসীন যুক্তফ্রন্ট সরকার কৃষক আন্দোলনের ঢেউকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে বিপলবীরা এগিয়ে যান এই আন্দোলন কে নেতৃত্ব দিতে।।“
(নকশালবাড়ি সম্পর্কে প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক,কমরেড বিনোদ মিশ্র,দেশব্রতী, সেপ্টেম্বর ১৯৯০)
নকশালবাড়ি আন্দোলনের রূপকার চারু মজুমদার একটি বিপলবী পার্টি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে ১৯৬৭ সালে লিবারেশন পত্রিকায় লিখেছিলেন আট টি দলিল,যা আজো এক অসামান্য এক চিন্তাভাবনার ফসল।তিনি বিপলবী পার্টি গড়ে তুলতে গিয়ে লিখলেন- ” বিপলব কখনো সফল হতে পারে না বিপলবী পার্টি ছাড়া। যে পার্টি দৃঢভাবে চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত, আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ লক্ষ লক্ষ শ্রমিক,কৃষক ও মধ্যবিত্ত যুবকের দ্বারা গঠিত, যে পার্টির অভ্যন্তরে পুরো গণতান্ত্রিক অধিকার আছে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার এবং যে পার্টির সভ্যারা স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে শৃঙ্খলা মেনে নিয়েছে,যে পার্টি শুধু ওপরের হুকুম মেনেই চলে না ,স্বাধীনভাবে প্রত্যেকটি নির্দেশকে যাচাই করে এবং ভুল নির্দেশকে অমান্য করতেও দ্বিধা করে না বিপলবের স্বার্থে,যে পার্টির প্রত্যেকটি সভ্য নিজের ইচ্ছায় কাজ বেছে নেন এবং ছোট কাজ থেকে বড় কাজ সব কিছুকেই সমান গুরুত্ব দেন; যে পার্টির সভ্যারা নিজেদের জীবনে মার্ক্সবাদী -লেনিনবাদী আদর্শকে প্রয়োগ করেন,নিজেরা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন,আরো আত্মত্যাগে আরো কর্মোদ্যম বাড়াতে যে পার্টির সভ্যরা কোনো অবস্থাতেই হতাশ হন না,কোনো কঠিন পরিস্থিতি দেখেই ভয় পান না,দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যান তার সমাধানে–এরকম একটা পার্টিই পারে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী ও মতের মানুষের ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গড়ে তুলতে।এই রকম একটি বিপলবী পার্টিই পারে ভারতবর্ষের বিপলবকে সফল করে তুলতে।”
তথ্যসূত্র:
চারু মজুমদার এর ৮টি দলিল, বিনোদ মিশ্র, রচনা সংগ্রহ, দীপংকর ভট্টাচার্য্য, ’নকশালবাড়ি ৫০ বছর’