এতকাল মিঞা কবিতা ছিল অসমীয়া বলয়ে অসমীয়া হরফে লেখা চর অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের দুঃখ, অভিমান, প্রতিবাদের ভাষা এবং মনের কথা প্রকাশের একটা মাধ্যম। এবং সেটা ছিল নিতান্তই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নিজস্ব বলয়ের অধীন। কিন্তু এই বিশ্বায়নের যুগে কোন কিছুই আর কোন বলয়ের ভিতরে টিকে থাকে না। বিশ্বায়নের বাজার সকল কিছুকেই পণ্য মনে করে। কোনওসময় খোলা বাজারের পণ্য, কোনওসময় রাজনৈতিক ফায়দা তোলার হাতিয়ারে পরিণত করে। মিঞা ভাষা, মিঞা কবিতার ক্ষেত্রেও এই মর্মান্তিক বিষয়টিই ঘটতে চলেছে। মিঞা কবিতাগুলো ফেসবুকের মাধ্যমে যখন একটু ছড়িয়ে পড়ল, যখনই অনুদিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সীমা অতিক্রম করে অন্যান্য জায়গায়, এমনকী ইংরেজিতে অনুবাদের সুত্রে বহির্বিশ্বে পা রাখল, ঠিক তখনই মিঞা কবিতা নিয়ে ভাষিক ইগোর রাজনীতিটা আত্মপ্রকাশ করল।
বিষয়টি আরো বুঝিয়ে বলা যাক। মিঞা কবিরা কোনকালেই তাদের লেখাতে দাবী করেননি যে, তাদের কবিতার ভাষা বাংলার কোন উপভাষা। এবং অসমীয়াভাষীরাও একে মিঞাদের মুখের জবান, তাদের জীবনচর্চা থেকে উদ্ভুত এক অন্য ধারার, অন্য বাচনশৈলির কবিতা হিসেবে দেখে আসছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে এনআরসি নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হতেই যখন গোটা আসামে বাংলাভাষী সংখ্যালঘুরা অবৈধ-বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী জুজুর নিউরোক্রেসির টানাবাহানার জেরে আদালতে চক্কর কেটে, এবং সবশেষে কয়েদখানা বা ডিটেনশন ক্যাম্পে জমায়েত হতে লাগলেন তখন বারবার মঞ্চ থেকে সংবাদপত্র, সোস্যাল মিডিয়ায় শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দু প্রান্তিক মানুষেরা এনআরসির যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন বলে এই যে চলতি বয়ান, সেই বয়ানটাকে পাল্টানোর একটা প্রয়াস দেখা দিল। বাংলাভাষীরা চান জাত্যাভিমানী অসমিয়াদের জেনোফবিয়ার বিরুদ্ধে আরো সংঘবদ্ধভাবে লড়াই করতে। সেই লড়াইয়ের কোলেটারেল ড্যামেজ হিসাবে তারা মিঞা কবিদের ওপর হওয়া এই মামলা, তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করা – এইগুলোকে আরো বেশী করে সামনে নিয়ে আসছেন। এমনকী কাউকে কাউকে বলতেই শোনা গেল –
“আমি খুব খুশী মিঞা কবিদের ওপর এফআইআর হওয়ায়। মিঞা কবিদের নিয়তি শহীদ হওয়া। কোনভাবেই সেটা আটকানো যাবে না। ওরা শহীদ হোক! কারণ শহীদ হলেই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাঙালির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রবণতা আসবে।”
অর্থাৎ মিঞা কবিদের ওপর হওয়া হিংসা, অত্যাচার এসবের আগুনে তারা হাত-পা সেঁকে উজ্জীবীত হয়ে এনআরসি এবং অসমীয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে চান। এই কথাগুলো আমাদের বরাক উপত্যকাসহ পশ্চিমবঙ্গেও উঠে আসছে। অর্থাৎ কীনা কিছু লোক শহীদ না হলে, কিছু লোক চরম লাঞ্চনার শিকার না হলে কোন আন্দোলন জমে ওঠে না। কোনও আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হতে পারে, এটা সেই মান্ধাতা আমলের চিন্তাধারা আঁকড়ে থাকা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মাথায় আসে না। এরা চান হিংসা-হানাহানি হোক, মিঞাভাষীদের ওপর আরো নিপীড়ন নেমে আসুক, ওদের ঘরছাড়া করা হোক, কিংবা (খোদা না খাস্তা) নেলী গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটুক।
তাই তো তারা চান অসমীয়া হরফে লেখা মিঞাভাষার কবিতা-সাহিত্যগুলোকে আত্মীকরণ করে ‘হে মা বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন‘ – এই আলিবাবার গুহায় নিয়ে জমা করতে। সেদিক দিয়ে আলিবাবা চল্লিশ চোরের সঙ্গে ভাবের ঘরে চুরি করা আমাদের এই বাংলার বুদ্ধিজীবী, আসামের বরাক উপত্যকার বুদ্ধিজীবীদের কোন পার্থক্য নেই।
আমাদের এসব ধারনা অলীক নয়, কারণ আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি যে ‘চলো পাল্টাই‘ শ্লোগান উঠেছে। অর্থাৎ কীনা এনআরসি প্রসঙ্গে বাংলাভাষী মুরুব্বিদের যে লড়াই ছিল মূলত হিন্দু বাঙালি লাঞ্চিত, পদদলিত, অবহেলিত, নিপীড়িত বলে, এই চলতি যে ন্যারেটিভ, তাকে এতকাল ওরা ভারতীয় মিডিয়া, বাংলা প্রচার মাধ্যম, এবং আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমকে বিলোচ্ছিলেন এবং লোকজন তা খাচ্ছিলোও বটে। এই তারাই আবার এনআরসি নিয়ে লড়াইতে কল্কে জুটছে না বলে এই পথে হাঁটছেন।
অথচ প্রত্যক্ষ ফ্যাক্ট হল আসামে বাঙালি মুসলমানরাও এনআরসি নিয়ে সমানভাবে লাঞ্চনা, নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, ডিটেনশন ক্যাম্পে দীর্ঘদিন আটক ছিলেন, আছেন। কেউ কেউ মারাও যাচ্ছিলেন, যাচ্ছেনও। কিন্তু সে খবরটাকে পাশ কাটিয়ে ‘হিন্দু বাঙালি বিপন্ন‘ শব্দমালা লাগিয়ে একটা ন্যারেটিভ চতুর্দিকে ফলাও প্রচার করা হচ্ছিলো, হচ্ছেও। এবং আমাদের বাঙালি সমাজের যে মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন তারাও সেই বাঙালি হিন্দুদের নিয়ে যে সব বুদ্ধিজীবী নেতারা চিন্তিত তাদের সুরে সুর মেলাচ্ছিলেন (অনেকটা এরকম যে কোন সভায় বা ক্লাবে একজন মুসলমান সভ্য রাখতেই হয় বলে যে নিয়ম, সেই নিয়ম মেনে অধিকাংশ আন্দোলন, সভা-সমিতি এগুলোতে আসর আলো করা সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী নেতারা সেই ‘বাবু হিন্দু’ বাঙালি নেতাদের সুরে সুর মিলিয়ে সেই ন্যারেটিভকেই সমস্বরে প্রচার করছিলেন।)।
কিন্তু এই মিঞা কবিরা কিছুসংখ্যক বিদ্বেষ ছড়ানো অসমীয়া মিডিয়ার কল্যাণে লাইমলাইটে আসার পর ওরা তাদের এই লড়াই এর রণকৌশল অন্যভাবে ভাবতে শুরু করেন। এইবার তাদের মাথায় আসে একতার কথা। যে একতার কথা এতকাল ধরে ওরা উহ্য রেখেছিলেন। কোনদিন মুখে ফুটে একতার কথা না বলে বরং বিজেপির সুরেই সুর মিলিয়ে বলছিলেন – না, হিন্দু বাঙালিদের আগে স্মরণ দেওয়া দরকার। এদের সমস্যাটাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। এবারে তাই চলতি ন্যারেটিভটাকে পাল্টে, সোজা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে ওরা একতার কথা বলতে শুরু করলেন- মিঞাভাষীরা আমাদের ভাই, মিঞাভাষীরা বাংলায় কবিতা লিখছেন, ওরা আমাদেরই তো লোক। এবং ওদের এই কুমীর কান্না বরাক উপত্যকা-ত্রিপুরা-বাংলাদেশ হয়ে পশ্চিমবাংলায় পৌঁছালো।
এবারে আসি কলকাতার বাবু বুদ্ধিজীবীদের কথায়। কলকাতার বাবুরা বহু বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের সাক্ষী লাতিন আমেরিকা, ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্ত হওয়া আফ্রিকার ভিন্নভিন্ন দেশের কবিতা পাঠ করে, অনুবাদ করে যান বরাবরই। এবং ওদের চোখে সেটা কয়লা খনি থেকে হীরে বের করে আনার মতো। ওরা যেই দেখলেন যে আসামের সেই কল্পিত কয়লা খনি থেকে মিঞা কবিতা নামক হীরে-জহরৎ উঠে আসছে, সেটার মালিকানা নিয়ে আসামের ইতিহাস, ভূগোলের কোনও ধারনা ছাড়াই হৈ হৈ রৈ রৈ করে তেড়ে এলেন: লুঙ্গি টুপি পরিহিত চর অঞ্চলে বাস করা লোকগুলো আমাদের ভাই, এরাও বাঙালি! সেই থেকে শুরু। ‘চলো পাল্টাই’ প্রসঙ্গে বলা যায় এটা একটা বিরাট চক্রান্ত। পাল্টাইপন্থীরা চান চিহ্নিত মিঞা কবিসহ সাধারণ মিঞাভাষী চর অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষ আরো বেশী করে যেন নীপিড়নের শিকার হোন, তাদের যেন গ্রামছাড়া করা হয়, রক্তক্ষয় হয়, এবং সেই রক্তক্ষয়ী পর্ব ঘুচে যাওয়ার পর তখন ওরা বলবেন –
‘এসো আর্য, এসো অনার্য, এসো ভাই মম, একসাথে আন্দোলন করি, আমরা বাঙালি।’
এইবার আসা যাক কেন মিঞা কবিতা বাংলা ভাষার কবিতা নয় সে প্রসঙ্গে। মিঞা কবিরা কখনোই স্বীকার করেননি যে তারা বাংলা ভাষায় লিখছেন কিংবা মিঞা ভাষা প্রায় বাংলারই মতো কিংবা বাংলার উপভাষা, কিংবা বাংলা এবং অসমীয়ার এক ‘ক্রিওল’। তারা বৃহত্তর অসমীয়া সভ্যতা, সংস্কৃতির মধ্যে থেকেই তাদের দুঃখ, যন্ত্রণা, চাওয়া-নাপাওয়া এসবের আখ্যান লিখে আসছেন। এখন বঙ্গবাসী বাবুরা চান আরএসএসীয় কায়দায় ‘ঘর ওয়াপসি’ হোক। যেহেতু কোন এককালে এদের পূর্বজরা বাঙালি ছিলেন, কোন এককালে ওদের পূর্বপুরুষরা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিলেন, তাই ওরা যেন ফের ‘ঘর ওয়াপসি’ করুক। এতে এক ঢিলে বঙ্গবাসী বাবুরা অনেকগুলো পাখি মারতে চান। যাতে করে আসামে যে শুধু বাঙালিরা চুড়ান্তভাবে নির্যাতিত সেই কান্না বিশ্বমিডিয়াকে দেখানো এবং বলা যায় না হয়ত যার হাত ধরে আমাদের দক্ষিণপন্থী বিজেপি সরকার খুব সহজেই এই কান্নাপালার দোহাই দিয়ে নাগরিকত্ম সংশোধনী বিল লোকসভা এবং বিধানসভার দুটি হাউসেই সহজে পাশ করিয়ে নিতে পারে। বলা যায় না হয়তো আমাদের বরাক উপত্যকা কিংবা পশ্চিমবাংলার সেই বাবু বুদ্ধিজীবীরা বিজেপির পাতা ফাঁদে পা রেখে, নিরীহ, আইন মেনে চলা মানুষগুলোর ওপরে হওয়া হিংসার আগুনে ওম নিয়ে, পাণ্ডিত্য জাহির করা বজায় রাখবেন।
বিবিসি’র পাতা থেকে সোস্যাল মিডিয়া, বিভিন্ন ব্লগ এবং ওয়েবজিনে বারবার বরাক উপত্যকা এবং পশ্চিমবঙ্গের বাবু বুদ্ধিজীবীরা মরিয়া প্রমাণে লেগেছেন, মিঞা কবিতা বাংলা ভাষারই কবিতা। অথচ তারা একবারও এই তথ্য দিচ্ছেন না যে অসমীয়া, ময়মনসিংহি, কামতাপুরিসহ নানা স্থানীয় ভাষা-উপভাষা মিলে এই ভাষার সৃষ্টি। এই ভাষার লিপি অসমীয়া বর্ণমালা। এবং মিঞা কবিরা শুধু মিঞা ভাষা নয়, অসমীয়া ভাষায়ও প্রচুর কবিতা লিখেছেন। রেহানা সুলতানা, কাজী নীলের অসংখ্য অসমীয়া ভাষায় লেখা কবিতা রয়েছে। সর্বোপরি মিঞা কবিতাগুলো যে উগ্র অসমীয়া শোভিনিজম এবং হিংস্র ভাষিক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে জেহাদ ঘোষণা – সেটাও বলা হচ্ছে না কোথাও। ভুল বার্তা, মিথ্যে ইতিহাস, পরিবেশনে ব্যস্ত আমাদের বাঙালি বাবু বুদ্ধিজীবীরা।
কেউ একবারও বুঝতে বা বোঝাতে চেষ্টা করছেন না প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিঞা নামক গালি শুনতে শুনতে, নির্যাতিত, অবহেলিত হতে হতে, এই কবিদের কলম দিয়ে বেরিয়ে আসছে তাদের বহুদিনের পুঞ্জীভূত বঞ্চনা আর অপমানের ধারাভাষ্য। ঘরে যে ভাষায় কথা বলেন, নিজের মা যে ভাষায় কথা বলেন সেই ভাষায় লিখে যাচ্ছিলেন তাদের যন্ত্রণার কথা। আর তাতেই পুলিশ-পেয়াদা নিয়ে ছুটে এলেন ডাঙরিয়া হীরেন গোঁহাইসহ অসমীয়া জাতীয়তাবাদীরা, আর বাঙালি বাবু বুদ্ধিজীবীরা জল্পনাকল্পনায় বসলেন কোনওভাবে ওই ভাষার কবিতাগুলোকে নিজেদের ভাষায় ফেলা যায় কীনা। শুরু করলেন হাংরি জেনারেশনের কবিতাগুলোর সাথে এর তুলনামূলক বিচারে। কতটুকু সাহিত্য হয়ে উঠেছে সেটার নিখাদ সমালোচনায়।
টেলিফোনিক সাক্ষাৎকারে ড. হাফিজ আহমেদ ‘দৈনিক যুগশঙ্খে’র অরিজিৎ আদিত্য মহাশয়কে বলেছিলেন –
“চরের মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলে তা কিন্তু শুদ্ধ বাংলা নয়, আমাদের নিজস্ব ভাষায় অন্তত একহাজারটি এমন শব্দ রয়েছে যেগুলো না বাংলা, না অসমীয়া। এখন, অসমীয়া অভিধান হেমকোষে এই শব্দগুলো স্থান পেয়েছে, কিন্তু বাংলা ভাষায় এগুলো ব্রাত্যই রয়ে গেছে”।
(ডি-রাষ্ট্রই যখন নিপীড়ক; পৃষ্ঠা – ১৮৫)
সেলিম হুসেন বলেছেন –
“আমরা কী, আমরা তা ভাল করেই জানি, অন্যরাই বরং আমাদের পরিচয় নিয়ে ভ্রান্তির শিকার। আসলে আমাদের ওপর একধরনের অস্তিত্ব সংকটের তকমা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা মূলত কৃত্রিম। আরোপিত।”
(ডি – রাষ্ট্রই যখন নিপীড়ক ; পৃষ্ঠা – ১৮৫)
এক অসহায় বাবার দলা পাকানো অভিমানের বিস্ফোরন হয়েছিল হাফিজ আহমেদের কবিতায় –
“লিখ
লিখি লোয়া
মই এজন মিঞা
এন আর চি’র ক্রমিক নং ২০০৫৪৩
দুই সন্তানের বাপেক মই
অহাবার গ্রীষ্মত জন্ম লব আরু এজনে
তাকো তুমি ঘিন করিবা নেকি
যিদরে ঘিন করা মোক? “
এন আর সির অত্যাচারে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী এক প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়ার বিবরণ কবি চান মিঞা দিয়েছেন –
“আবার ডিটেনশন ক্যাম্পে বইসা মনে পরলো
হারে, এই বিল্ডিংডা তো আমিই বানাইছিলাম
এহন আমার কিছু নাই
মাত্র আছে একযোরা পুরান লুংগী, আধপাকা দাড়ি
আর দাদার নাম থাকা ছয়ষট্টীর ভোটার লিস্টের
এফিডেভিট কপি।”
বৃহত্তর অসমীয়া জনজাতির কাছে নিজের প্রাপ্যটুকু পেতে, অসমীয়া মায়ের সৎমা সুলভ আচরণে তীব্র মনোকষ্টে রেহানা সুলতানা লিখছেন –
“হাজার লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য করিও মই চিঞরি
চিঞরি কও –
আই! মই তোমাকেই ভাল পাঁও। “
১৯৮৩ সালের ইতিহাসের বর্বরতম নেলী গণহত্যা, একরাতে সম্পূর্ণ মুসলমান গ্রামটি শ্মশানে পরিণত হয়েছিল, একটা বাচ্চাকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। সেই মর্মান্তিক ক্ষোভ, স্বজন হারানোর ব্যাথা থেকেই কবি কাজী নীল লিখেছেন –
“যে দেশে ৮৩ তে মানুষ মেরে শালার বেটারা জল্লাদের
মতো উল্লাস নৃত্য নাচে,
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।”
মিঞা গালি শুনতে শুনতে শেষে রুখে দাঁড়ানো চর অঞ্চলের যুবকদের বিদ্রোহী সত্ত্বার জানান দিয়েছেন কবি আব্দুর রহিম –
“আমারে আর মিঞা বিলা
গাইল দিয়েন্না
মিঞা বিলা পরিচয় দিতে
এহন আর আমার
সরম করে না
ভাল যুদি নাই পাইন
ছলনা আর কইরেন্না
কাঁটাতারের দাগ বিছরায়েন্না
তিরাশি, চোরানবৈ, বার, চোদ্দর
কথা ভুইলা যায়েন্না
অই আগুনের পোরা দাগরে
কাঁটাতারের দাগ কৈয়েন্না –“
চর অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠীর চোখে চোখ রেখে শেষ স্পর্ধিত উচ্চারণ রেহানা সুলতানা লিখেছেন –
“নাই নাই, শুনক
মিঞাই আপোনাক কাহানিও গোলাম করিব বিচরা নাই
কিন্তু আপোনার গোলামিও আরু মিঞাই না খাটে সেয়ে,
মিঞার পোয়ালীয়ে আজি আপোনাক সঁকিয়াই দিছে
আপুনি যুদ্ধ করিব অস্ত্ররে
মিঞাই যুদ্ধ করিব কলমেরে
কারন শুনামতে
অস্ত্রর ধারতকৈ কলমর ধার বেশী চোকা
বেশী শক্তিশালী।
‘জয় আই অহম’।”
এই এতো এতো উদাহরণ দেওয়ার কারণ একটাই – মিঞা কবিরা ভাষা আর সাহিত্যের আন্দোলন করছেন না, বরং নিজেদের যন্ত্রণার ভাষ্যে, আন্দোলনে হাতিয়ার করেছেন সাহিত্যকে। এবং অন্য কোনও জাতিগোষ্ঠী কীভাবে নিজের যন্ত্রণা প্রকাশ করবেন, কোন ভাষায় করবেন, সেটা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার যে আমাদের একদম-ই নেই, সেটা সবার প্রথম আমাদের বুঝতে হবে। অসমীয়া উগ্র জাতীয়তাবাদ ঠেকাতে বাংলা জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নেওয়াও ফ্যাসিবাদ। এবং এতে করে মিঞা জনগোষ্ঠীর বিপদ বাড়ানোর সাথে সাথে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর ওপরও বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।
তাই মিঞা কবিতা বাংলা ভাষায় লেখা হচ্ছে না কী মিঞা ভাষায়, সেই বিতর্ক-আলোচনায় না গিয়ে আমরা বরং দেখি মিঞা কবিরা কী লিখছেন, কী বলতে চাইছেন, কোন যন্ত্রণায় নীল হয়ে আছেন তারা। এনআরসি নামক রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যা স্বাধীনতা পরবর্তী আসাম আন্দোলন বা উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদী শক্তির হিংস্র ভাষিক আগ্রাসন বা জেনোফবিয়ার ভয়াল রূপ তার বিরুদ্ধে অতি অবশ্যই বাঙালিসহ আসামের সমস্ত ভাষিক সংখ্যালঘুর সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেটা কোনভাবেই মিঞা জনগোষ্ঠীর মানুষদের বলির পাঠা করে নয়। বরং মানুষ হিসাবে তাদের পাশে দাঁড়াই এই লড়াইতে। মিঞা কবিদের ওপর এই রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধের দাবী জানাই একযোগে এবং তাদের সুরক্ষিত থাকতে সাহায্য করি। অনেক তো হল, এবারে বরং বুদ্ধিজীবীবাবুরা বুদ্ধিমান ছাগল থেকে মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠুন।