গত ১৯ মে, ২০১৭, ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে গঠন করা হয়েছে ‘অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি‘। এই কমিটি কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় আগামী ১ অক্টোবর, অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচি শুরু হবে, ৭ নভেম্বর একটি মহাসমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিলের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হবে। এইসময়ের মধ্যে দেশের প্রগতিশীল শ্রমিক-নারী-যুব-ছাত্র-ক্ষেতমজুর-কৃষক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ঢাকায় সভা-সেমিনার-প্রদর্শনী-সমাবেশ-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানামাত্রিক কর্মসূচি পালন করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
এই জাতীয় কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন সিপিবি-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যেমন, বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ–মার্কসবাদী), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ–মাহবুব), গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড কম্যুনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গরিব মুক্তি আন্দোলনসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও শ্রেণী-পেশার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই কমিটিতে যুক্ত হয়েছেন। অনুষ্ঠান সর্বস্বতা নয় বরং অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য সকল মানুষের কাছে তুলে ধরে এদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যেই এই জাতীয় কমিটি কর্মসূচি পালন করবে বলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান। বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে দুই যুগ্ম-আহ্বায়কের এবং সমন্বয়কের কিছু উদ্ধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক হবে:
১)
“সত্যি বলতে কি ‘প্রায়োগিক ভ্রান্তির’ (মার্কসবাদ-সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ এর প্রয়োগ – লেখক) বীজ শুধু স্তালিন আমলেই নয়, এ বপন শুরু হয়েছিল আরও আগে, লেনিনের জীবনের শেষ পর্যায় থেকেই…” এবং “…স্তালিন আমলেই পার্টি একনায়কত্ব তথা পার্টিতে আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। বিশ্ব বিপ্লবের সম্ভাবনা ক্ষীণ বিবেচনায় তখন ‘এক দেশেই সমাজতন্ত্র’ রক্ষা করার নীতি প্রধান হয়ে উঠে, যা রক্ষণশীলতার পটভূমি নির্মাণে সহায়ক হয়েছে।”
কথাগুলো বলছেন যুগ্ম-আহ্বায়ক আহমদ রফিক তাঁর ‘সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্র ও রোজা লুক্সেমবার্গ এর চিন্তা’ নামক প্রবন্ধে (নতুন দিগন্তঃ এপ্রিল–জুন, ২০১৭)।
আহমদ রফিক সাহেবের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিলো অবিভক্ত ভারতবর্ষের সুভাষপন্থী নিখিল বঙ্গ ছাত্র কংগ্রেস (এবিএসসি) এর মাধ্যমে;এবং নড়াইল শহর কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন সহপাঠী বন্ধু দেবুর চাপাচাপিতে। তৎকালীন সিপিআই এর ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ফেডারেশন’ চেষ্টা করেছিল তাঁকে সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য, কিন্তু তাঁদের নীতির প্রতি দ্বিমত পোষণ করে যুক্ত হননি। কারণ তখন তিনি জাতীয়তাবাদী স্বাদেশিকতার রাজনীতিতে আচ্ছন্ন, এবং মার্কসবাদ বিষয়ক চটি বইয়ের চেয়ে বিপ্লবীদের জীবনকাহিনী অনেক বেশী আকর্ষণীয় ছিল তাঁর কাছে (তথ্যসূত্র: পথ চলতে যা দেখেছি, আহমদ রফিক)।
এই প্যারার শুরুর উদ্ধৃতিগুলোর সাথে সঠিক মার্কসবাদী–লেনিনবাদি রাজনীতি সচেতন পাঠক লিঁও ত্রতস্কির লেখার আশ্চর্য মিল খুঁজে পাবেন। বিস্তারিত আলোচনা আমরা পরবর্তীতে তুলে ধরব। এহেন ত্রতস্কাইট আহমদ রফিক সাহেব যুগ্ম-আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির।
২)
“বিপ্লবী আন্দোলনে বুর্জোয়ারা এবং পেটি-বুর্জোয়ারা যোগ দেন, নেতৃত্বও দেন, কিন্তু তাঁরা আসেন শ্রেণীচ্যুত হয়ে…”
কথা গুলো বলছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ‘অক্টোবর বিপ্লবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য’ প্রবন্ধে (কাজী নূর-উজ্জামান স্মারক বক্তৃতা, ২০১৭)।
উদাহরণ দিয়ে বলছেন “আদি মার্কসবাদীদের সবাই ছিলেন বুর্জোয়া শ্রেণীর। মার্কস ছিলেন বিত্তবান ঘরের সন্তান…, এঙ্গেলসের ছিল পারিবারিক শিল্পকারখানার মালিকানা। লেনিন ছিলেন সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবাবের সন্তান; ত্রতস্কির পিতার ছিল বিশাল জমিদারী”। প্রশ্ন করে বলছেন এঁদের শ্রেণীচ্যুতিটি কেন ঘটল? এবং উত্তরে বলছেন ঘটেছে দুই কারণে, প্রথম কারণ সংবেদনশীলতা, দ্বিতীয় কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ। ‘শ্রেণীচ্যুত হওয়া‘ আলোচনার পূর্বে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ত্রতস্কি প্রসঙ্গে যেখানে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁকে উল্লেখ করছেন আদি মার্কসবাদী হিসেবে।
বামপন্থী রাজনীতির সংকট কোথায় এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক চৌধুরী বলছেন,
“সমস্যা হল আন্দোলনগুলোর নেতৃত্ব শ্রেণিচ্যুত হতে পারেনি”
(তথ্যসূত্র:সাপ্তাহিক একতা, ১৬ অক্টোবর ২০১৬)।
কোথায় পেলেন তিনি এই ‘শ্রেণীচ্যুত হওয়া‘ তত্ত্ব। পুঁজিবাদ বিরোধী বক্তৃতা বা লেখা তিনি নিয়মিতই প্রকাশ করে থাকেন, কিন্তু লেনিনবাদের আরও গভীরে তিনি যদি অনুসন্ধান চালাতেন তাহলে খুঁজে পেতেন তাঁর এই ‘শ্রেণীচ্যুত হওয়া‘ তত্ত্ব পরিপূর্ণভাবে লেনিনবাদ বিরোধী।
লেনিন তাঁর ‘Leftwing Communism, an Infantile Disorder‘ বইয়ে লিখেছেন,
“আমরা দেখছি যে আমাদের বামপন্থীরা প্রলেতারীয় লৌহশৃঙ্খলা ও তাঁর প্রস্তুতির কথাটা একদম বোঝে না, শ্রেণীচ্যুত পেটি-বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর মনোবৃত্তিতে তারা একেবারে আচ্ছন্ন। … গুরুগম্ভীর বুলি বিতরণ– এ হলো শ্রেণীচ্যুত পেটি-বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য। সংগঠিত প্রলেতারীয় কম্যুনিস্টরা নিশ্চয়ই এই অভ্যাসের জন্য শায়েস্তা করবে অন্ততপক্ষে উপহাস হেনে ও সমস্ত দায়িত্বশীল পদ থেকে বিতারণের ব্যবস্থা করে। শ্রমিকেরা পেটি-বুর্জোয়া নয় …এটা বোঝেনা কেবল শ্রেণীচ্যুতেরা”।
কী নির্মম ভাষায় কমরেড লেনিন এই ‘শ্রেণীচ্যুত হওয়া‘ তত্ত্বকে পরিহাস করছেন। মার্কস এবং এঙ্গেলস এক সার্কুলারপত্রে লিখেছেন,
“শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তিসাধন হওয়া চাই শ্রমিকশ্রেণীর নিজের কাজ। অতএব, যারা খোলাখুলি বলেন, নিজেদের মুক্ত করার মতো শিক্ষাদীক্ষা শ্রমিকদের নেই, উপর থেকে, মানবদরদী বড় বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়াদের সাহায্যে তাঁদের মুক্ত করতে হবে, তাদের সঙ্গে আমরা সহযোগিতা করতে পারি না”।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায় আমাদের দেশের বামপন্থী আন্দোলনের প্রধানতম সংকট হচ্ছে, যে মধ্যশ্রেণী এর নেতৃত্বে ছিলেন তারা শ্রেণীচ্যুত হতে পারেনি। এবং তিনিসহ আমাদের দেশের বামপন্থী মহলের অনেকেই যুক্তি তুলে ধরেন যে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও এঁরা তো কেউ শ্রমিক শ্রেণী থেকে আসেননি, শুধু স্তালিন ছাড়া। এতে মনে হতে পারে কথাতো ঠিকই। কিন্তু যুক্তিটি অসার। কারণ, যারা এই যুক্তি উল্লেখ করছেন তারা শ্রেণী-প্রশ্নটি বুঝতে পারছেন না। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কখনোই ব্যক্তির একনায়কত্বের কথা, নেতৃত্বের কথা বলে নাই। ব্যাখ্যা করেছেন শ্রেণীর একনায়কত্বের কথা, শ্রেণীর নেতৃত্বের কথা।
পার্টিতে যেহেতু গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেহেতু ব্যক্তি কে নেতা হচ্ছেন, তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কোন শ্রেণী নেতার ভূমিকায় আছে। ‘বিপুল সংখ্যায় বুদ্ধিজীবীকে দলভুক্ত কর’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে মাও সেতুঙ বিপ্লবী আদর্শের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব আলোচনা করতে গিয়ে ঔপনিবেশিক এবং আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলোর বুদ্ধিজীবী ও পুঁজিবাদী দেশগুলোর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যকার পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন, এবং এই পার্থক্যকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারলে বিপ্লবের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব উপলব্ধি এবং তাঁদের সম্পর্কে সঠিক নীতিনির্ধারণও যে সম্ভব নয়, তা বলেছেন।
১ ডিসেম্বর ১৯৩৯ চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত যা মাও সেতুঙ নিজে খসড়া করেন,
“…আমাদের পার্টি এবং আমাদের সেনাবাহিনী এরই মধ্যে একটি সুপরীক্ষিত শক্তিশালী কর্মী বাহিনীকে বিকশিত করেছে এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম”।
চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির এই সিদ্ধান্তের প্রায় ১৩ বছর পূর্বে কমরেড স্তালিন চীনের তরুণ তথা ছাত্র সমাজ, ও বুদ্ধিজীবীদেরকে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বলেন,
“এটা মনে রাখা দরকার যে চীনা তরুণদের মতো আর কেউই এমন গভীর আর পরিপূর্ণভাবে সাম্রাজ্যবাদী নির্যাতনের শিকার হয়নি অথবা এমন সূক্ষ্ম ও যন্ত্রণাপূর্ণভাবে এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন নয়। চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি এবং চীনা বিপ্লবীদের এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে হিসেবের মধ্যে রাখতে হবে এবং তরুণদের মধ্যে তাদের কাজ সর্বোচ্চ মাত্রায় বৃদ্ধি করতে হবে”।
কমরেড স্তালিন ও মাও সেতুঙ-এর এই গুরুত্বপূর্ণ দলিলের কোথাও ‘শ্রেণীচ্যুত হওয়া’ তত্ত্ব নেই, উল্টো বলা হয়েছে কম্যুনিস্ট পার্টিকে গড়ে তুলতে হবে বুদ্ধিজীবীদেরকে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম করে।
“বক্তা, লেখক, সংগঠক হিসেবে ত্রতস্কিও ছিলেন অনন্য সাধারণ। তাঁর চিন্তাতেও বিপ্লবের অবস্থান ছিল সার্বক্ষণিক। সাহস ছিল দুর্দান্ত। অক্টোবর বিপ্লবের শুরুর সময়টাতে নির্বাসিত অবস্থায় ছিলেন তিনি আমেরিকায়, খবর পাওয়ামাত্র দেশে ছুটে এসেছেন, এবং বিপ্লবী তৎপরতায় দক্ষতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন”
কথা গুলো বলছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ‘অক্টোবর বিপ্লবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য‘ প্রবন্ধে।
পুঁজিবাদ বিরোধিতার মুখোশের আড়ালে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন ‘ত্রতস্কাইট’ হিসেবে। বিস্তারিত আলোচনা আমাদের এই লেখার পরবর্তী অংশে তুলে ধরবো। এবং এহেন ত্রতস্কাইট অধ্যাপক চৌধুরী যুগ্ম-আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির।
৩)
হায়দার আকবর খান রনো ‘কার্ল মার্কস কেন সঠিক ছিলেন‘ এই নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন একটি অনলাইন পত্রিকায় (বিচ্ছুরণ, অগাস্ট ০৫, ২০১৭)। প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বলছেন,
“কার্ল মার্কসের জীবদ্দশা থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর বক্তব্য ও তত্ত্বকে বিকৃত করে এমনভাবে পরিবেশন করা যাতে মার্কসীয় তত্ত্ব ভুল বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রবণতা এখনও আছে। মার্কসকে যারা ভালভাবে অধ্যয়ন করেননি তাদেরকে সহজেই একটা বুঝ দেয়া যায় যে মার্কসবাদ কোনো প্রমাণিত ও বিশ্বাসযোগ্য মতবাদ নয়”।
মার্কস কেন সঠিক – এটি প্রমাণের তাগিদ থেকে তিনি বেশ কিছু উদ্ধৃতি হ্যাল ড্র্যাপার-এর বই ‘Karl Marx and Theory of Revolution’ থেকে তুলে ধরেন, এবং পাঠকের সামনে হ্যাল ড্র্যাপারকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ‘মার্কস বিশেষজ্ঞ‘ হিসেবে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে হ্যাল ড্র্যাপার-এর রাজনৈতিক পরিচয় কী? ১৯১৪ সনে আমেরিকায় জন্ম গ্রহণকারী এই ব্যক্তি একজন বিখ্যাত ত্রতস্কাইট রাজনৈতিক কর্মী এবং লেখক। ১৯৩২ থেকে ১৯৯০ সাল, অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তাঁর কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে আমেরিকান ত্রতস্কিপন্থীদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে, এবং ফলাফল হিসেবে তিনটি ত্রতস্কিপন্থী বিশ্লেষণ বেরিয়ে আসে,
১) তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন হচ্ছে ‘Degenerated Workers’ State’
২) তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন হচ্ছে ‘State Capitalist’ এবং
৩) তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘Worker’s State’ অথবা ‘State Capitalism’ কোনটাই নয়।
কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে ‘Bureaucratic Collectivism’। রনো সাহেব বর্ণিত ‘মার্কস বিশেষজ্ঞ’ হ্যাল ড্র্যাপার ছিলেন উপরে উল্লিখিত তৃতীয় মতধারার অনুসারী। তাঁর প্রবন্ধের শুরুতে রনো সাহেব হাহাকার করে বলছেন মার্কসের তত্ত্ব এর বিকৃতির কথা এবং অভিযোগ করে বললেন,
“যারা ভালভাবে অধ্যয়ন করেননি তাদেরকে সহজেই একটা বুঝ দেয়া যায়”।
কিন্তু আমাদের প্রশ্ন এক্ষেত্রে তিনি নিজে কী করলেন? একজন ঘোষিত ত্রতস্কাইটকে ‘মার্কস বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে হাজির করলেন – এখন এসব আর আমাদেরকে অবাক করে না। কারণ তিনি তাঁর দল সিপিবির অনুসৃত নীতি থেকে একচুলও সরেননি। এক্ষেত্রে তাঁর দলের প্রাক্তন সভাপতি মণি সিংহ-এর একটি উদ্ধৃতি খুবই প্রাসঙ্গিক – তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৫৩ তম জন্মদিবস উপলক্ষে কম্যুনিস্ট পার্টি অফিসের অনুষ্ঠানে মণি সিংহ তাঁর বক্তব্যে বলেন,
“…বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পঞ্চদশ সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে …’
(তথ্যসূত্র: দৈনিক সংবাদ, ১৭ মার্চ, ১৯৭৩)।
বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় রনো সাহেবরা মার্কসকে সঠিক প্রমাণের যুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন ত্রতস্কিপন্থী হ্যাল ড্র্যাপারকে – মার্কসবাদের এত বড় বিকৃতি সাধনের জবাব বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী দেবেই দেবে। এবং এহেন শোধনবাদী ও ত্রতস্কাইট হায়দার আকবর খান রনো সমন্বয়ক নির্বাচিত হয়েছেন অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির।
প্রসঙ্গঃ আহমদ রফিক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং ত্রতস্কিবাদ
১)
লিঁও ত্রতস্কি সংক্রান্ত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কিছু মতামত যা আমরা নিয়েছি তাঁর ‘অক্টোবর বিপ্লবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য’ প্রবন্ধ (কাজী নূর-উজ্জামান স্মারক বক্তৃতা, ২০১৭) থেকে,
ক) ত্রতস্কির ‘মার্কসবাদী’ হয়ে উঠার ইতিহাস ব্যাখ্যায় অধ্যাপক চৌধুরী ত্রতস্কি এবং তাঁর প্রথম স্ত্রীর কথোপকথন থেকে মতামত আকারে বলছেন,
“পরবর্তীতে ত্রতস্কিও মার্কসবাদী হয়ে পড়েন। অত্যন্ত প্রবলভাবে”।
খ) লেনিন এবং ত্রতস্কিকে ‘আদি মার্কসবাদী’ আখ্যা দিয়ে, এবং তাঁদের পারিবারিক অবস্থান তুলে ধরে অধ্যাপক চৌধুরী সিদ্ধান্ত টানছেন যে দুজনেই ‘শ্রেণীচ্যুত হয়ে’ বিপ্লবী রাজনীতিতে এসেছেন।
গ) অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের তথ্য প্রবন্ধের মাধ্যমে তাঁর পাঠকদেরকে জানাচ্ছেন এবং সেটি হচ্ছে লেনিন এবং ত্রতস্কির মধ্যে মিল-অমিল। মিল দেখাতে গিয়ে তিনি বলছেন,
“তাঁর (ত্রতস্কির-লেখক) চিন্তাতেও বিপ্লবের অবস্থান ছিল সার্বক্ষণিক। সাহস ছিল দূর্দান্ত। অক্টোবর বিপ্লবের শুরুর সময়টাতে নির্বাসিত অবস্থায় ছিলেন তিনি আমেরিকায়, খবর পাওয়ামাত্র দেশে ছুটে এসেছেন, এবং বিপ্লবী তৎপরতায় দক্ষতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন।”
অমিল প্রসঙ্গে অধ্যাপক চৌধুরী যে গল্পের অবতারণা করেছেন তা হচ্ছে, লেনিন এবং ত্রতস্কির ভিন্ন পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠা, এবং পরবর্তীতে নিজ নিজ পরিবারকেন্দ্রিক সম্পর্কের ভিন্নতা। স্তালিন এবং ত্রতস্কি প্রসঙ্গে তিনি বললেন,
“স্তালিনের চাইতেও মেধাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও লেনিনের মৃত্যুর পর ত্রতস্কিকে চলে যেতে হয়েছিল দেশ ছেড়ে এবং লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিনের সময়ে আমলাতন্ত্রের শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। ত্রতস্কিকে নির্বাসিত করার প্রয়োজনে ও প্রক্রিয়াতে পার্টিতে বিশুদ্ধকরণদরকার হয়ে পড়ে।”
অধ্যাপক চৌধুরীর মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বিরোধী অবস্থান এবং এই ধরনের বিকৃত ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টাকে আমাদের ধারাবাহিক আলোচনায় তুলে ধরবো।
২)
আহমদ রফিক তাঁর প্রবন্ধে (সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্র ও রোজা লুক্সেমবার্গ, নতুন দিগন্তঃ এপ্রিল-জুন, ২০১৭) সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতন্ত্রের অঘটনেরকারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন,
“আমার (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম – লেখক) মতে মার্কসবাদ-সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ সম্পর্কে কতকগুলো মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে গুরুতর কতকগুলো ত্রুটির ফলেই এই বিপর্যয়ের পটভূমি রচিত হয়েছে। এর শুরু মূলত স্তালিন আমল থেকে” এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল ‘ব্যক্তি সত্তার প্রতি অবহেলা’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থার অভাব’।”
এছাড়াও আহমদ রফিক সাহেব তাঁর লেখায় সিদ্ধান্ত আকারে বলছেন,
“লেনিন তাঁর আগেকার তাত্ত্বিক অবস্থান (সর্বহারা একনায়কত্ত্বতথা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব) থেকে সরে এসে পার্টি সংহতি, পার্টি শক্তি ও পার্টি একনায়কত্বের পক্ষে দাঁড়াতেবাধ্য হয়েছিলেন”।
একই লেখায় কিছুক্ষণ পরেই আহমদ রফিক জ্যোতিষী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বলেন,
“আমার ধারণা, লেনিন আর দশ-পনেরোটা বছর বেঁচে থাকলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সর্বহারা একনায়কত্ব তথা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের বাস্তব ও কার্যকরী রূপায়ন ঘটাতে তৎপর হতেন। অবশ্য গোটা বিষয়টি এখন অনুমানের”।
সর্বহারা একনায়কত্ব, শ্রমিক শ্রেণী এবং তাঁর প্রধান হাতিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টি সম্পর্কে আহমদ রফিক সাহেবের আদৌ কোন ধারণা আছে কিনা সেই প্রশ্ন আমরা অবশ্যই তুলব। শুধু ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ নামক পুস্তিকাটি যদি এই ভদ্রলোক বুঝে পড়তেন তাহলে লেনিনকে নিয়ে এই ধরনের ইতিহাস বিকৃত করার সাহস তিনি পেতেন না। অবশ্য শুধু বাংলাদেশেই নয় সারাবিশ্বব্যাপী শোধনবাদী ও ত্রতস্কিপন্থীরা যৌথভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিকৃতি সাধনে তাঁদের সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছে।
লিঁও ত্রতস্কি তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন ১৯০০ সালের দিকে। ১৯০৩ সালে পার্টির মধ্যে যখন বলশেভিক এবং মেনশেভিক পার্থক্য (পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস) সুনির্দিষ্ট হয়ে উঠল ত্রতস্কি তখন মেনশেভিকদের পক্ষে যোগ দেন। এবং এই দ্বিতীয় কংগ্রেসে কমরেড লেনিন সম্পর্কে ঘোষণা আকারে ত্রতস্কি বলেন,
“…With the energy and talent peculiar to him, assumed the role of the party’s disorganizer”
(তাঁর পক্ষে অসঙ্গতশক্তি ও মেধা সমেত তিনি পার্টি ধ্বংসকারীর ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছিলেন)।
নিজের রাজনৈতিক জীবনের শুরুর দিন থেকে ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত ত্রতস্কি কখনো মেনশেভিকদের সঙ্গে, কখনোওবা মধ্যপন্থীদের সঙ্গেই ছিলেন, কখনোই বলশেভিকদের সঙ্গে ছিলেন না – ১৪বছরের অধিক সময় বলশেভিকদের শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক দল গঠন থেকে শুরু করে সবধরনের রাজনৈতিক নীতি, কর্মসূচির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। ১৯০৫ সালে রাশিয়ার প্রথম বিপ্লবের পর যে ‘Soviet of Worker’s Deputies’ (এটিই ছিল প্রথম সোভিয়েত) গঠিত হয়, তার সদস্য হয়েছিলেন ত্রতস্কি। প্রথম এই সোভিয়েত নিয়ে কমরেড লেনিন বলছেন,
“Broad fighting union of socialists and revolutionary democrats-lacking definite form.”
(সমাজতন্ত্রী ও বিপ্লবী গণতন্ত্রীদের বৃহৎ লড়াকু ঐক্য – সুনির্দিষ্ট গঠনবিহীন)।
ত্রতস্কি পরিচিতি পেয়েছিলেন একজন ভালো বক্তা ও লেখক হিসেবে, এবং এই ধরনের গুণাবলীর কারণে খুব সহজেই পেটি-বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এবং শুধু এই কারণেই তিনি ১৯০৫ সালের প্রথম সোভিয়েতে সদস্যপদ পেয়েছিলেন। প্রথম সোভিয়েতের প্রথম চেয়ারম্যান ক্রুস্তালেভ নোজার গ্রেফতার হয়ে যাবার পর ত্রতস্কি এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। ইতিহাসবিদ পক্রভস্কি ১৯০৫ সালে রাশিয়ার প্রথম বিপ্লবের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে প্রথম সোভিয়েতের দ্বিতীয় চেয়ারম্যান হিসেবে ত্রতস্কির ভূমিকা তুলে ধরে বলছেন,
“কর্মতৎপরতার সমগ্র পর্যায় জুড়ে পিটার্সবার্গ সোভিয়েতের প্রধান হিসেবে ছিলেন একজন খুবই বুদ্ধিমান ও ধুরন্ধর মেনশেভিক, যিনি বিপ্লবী কথাবার্তার সাথে মেনশেভিক মর্মবস্তু সমন্বয়করণের ব্যাপারে ছিলেন অভ্যস্ত। ঐ মেনশেভিকটির নাম ত্রতস্কি। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত, পূর্ণাঙ্গ মেনশেভিক যার সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিষয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না এবং বিপ্লবকে তার পূর্ণাঙ্গতায় নিয়ে যাওয়া, অর্থাৎ জারতন্ত্র উৎখাতের তিনি ছিলেন বিরোধী”
(M. N. Pokrovsky, Brief History of Russia,Vol. II, p. 320)।
ত্রতস্কি ১৯০৬ সনে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় একটি ছোট রাজনৈতিক কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং এখান থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন – যথারীতি বলশেভিকদের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। সময়ের পরিক্রমায় ১৯১২ সালে বলশেভিক বিরোধী ‘অগাস্ট ব্লক’-এ যোগদান করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ত্রতস্কি মধ্যপন্থীদের অবস্থান নেন, এবং বলশেভিকদের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-সংক্রান্ত নীতির অর্থাৎ, “যুদ্ধের সময় ‘আমাদের নিজস্ব’ সরকারকে পরাজিত করার জন্য কাজ করা,প্রতিটি দেশে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করা, অর্থাৎ বুর্জোয়াজীর বিরুদ্ধে বিপ্লবের ডাক দিয়েছিল, প্রকৃত বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীদের নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল” সরাসরি বিরোধিতা করেন। ফলে যুদ্ধ বিরোধী কিছু কথা এবং লেখা ত্রতস্কি প্রকাশ করলেও লেনিন এবং বলশেভিকদের নীতির বিরুদ্ধে তিনি বলতেন, ‘a concession to the political methods of social-patriotism’ (সামাজিক-দেশপ্রেমের রাজনৈতিক পদ্ধতির সাথে আপোষ)।
সাম্রাজ্যবাদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে তৎকালীন সমাজতন্ত্রীদের যে সংগ্রাম চলছিলো, তাকে কীভাবে আরও বেগবান করা যায় – তার করণীয় নির্ধারণে সুইজারল্যান্ড-এর যিমারওয়ালডে সমাজতন্ত্রীরা মিলিত হন, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকেরাও অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু ত্রতস্কি বলশেভিকদের পক্ষাবলম্বন না করে মধ্যপন্থাকেই আঁকড়ে ধরেন। কমরেড লেনিন এবং বলশেভিকবাদের ক্রমাগত বিরোধিতা করে ১৯১৩ সালের দিকে লেখা এক পত্রে লেনিন সম্পর্কে ত্রতস্কি বলছেন,
“The wretched squabbling systematically provoked by Lenin, that old hand at the game, that professional exploiter of all that is backward in the Russian labour movement, seems like a senseless obsession…. The entire edifice of Leninism is built on lies and falsification and bears within itself the poisonous elements of its own decay.”
(Leon Trotsky, Letter to Chkeidze, 1913)।
(অনুবাদ: লেনিন কর্তৃক কৌশলের সাথে ঝগড়াঝাঁটি উস্কে দেয়া– এইখেলাতে সে পুরোনো ওস্তাদ, রাশিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের পশ্চাৎপদ সকল কিছুর দক্ষ সুযোগ গ্রহণকারী–অনুভূতিশূন্য নেশার মতো মনে হয়। লেনিনবাদের সমগ্র প্রাসাদ মিথ্যা আর বিকৃতিকরণের উপর নির্মিত এবং এর মধ্যে রয়েছে তার নিজের ক্ষয়িষ্ণুতার বিষাক্ত উপাদানসমূহ।)
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর আলেক্সান্দ্রা কোলনতাইকে লেখা একটি চিঠিতে লেনিন উল্লেখ করছেন যে,
“আমার মতে, আমাদের প্রধান কাজ হলো সামাজিক-দেশপ্রেমিকদের সাথে (অথবা, যা কিনা আরো বিপজ্জনক, সেই ত্রতস্কি গংয়ের মতো দোদুল্যমানদের সাথে) ‘ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার নির্বোধ প্রচেষ্টায় রত থাকার বিরুদ্ধে সতর্ক প্রহরা গড়ে তোলা এবং অবিচল আন্তর্জাতিকতাবাদী অনুপ্রেরণার সাথে আমাদের নিজেদের পার্টির কাজ চালিয়ে যাওয়া।”
(V. I. Lenin, The Revolution of 1917, Vol. I)
এবং ১৯১৭ সনের মে মাসে লিখিত এক রিপোর্টে লেনিন পেটি-বুর্জোয়া দোদুল্যমানতার বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার তাগিদ দিয়ে ত্রতস্কি প্রসঙ্গে বলেন,
“The vacillations of the petty-bourgeois: Trotsky …”
(V. I. Lenin, Collected Works, Vol. XXX) (পেটি-বুর্জোয়া ত্রতস্কির দোদুল্যমানতা)।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন এই পেটি-বুর্জোয়া ত্রতস্কি তখন পর্যন্ত বলশেভিক পার্টিতে যোগদান করেননি। রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর ত্রতস্কি দেশে পৌঁছান এবং পেত্রগ্রাদে এসে ‘Interborough’ নামক এক সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক গ্রুপে যোগ দেন। অথচ আমাদের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর পরিণত বয়সে নতুন গল্প ফেঁদে বলছেন, ত্রতস্কির চিন্তাতে বিপ্লবের অবস্থান ছিল সার্বক্ষণিক; অক্টোবর বিপ্লবের শুরুর সময়টাতে খবর পাওয়ামাত্র দেশে ছুটে এসেছেন এবং বিপ্লবী তৎপরতায় দক্ষতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। ত্রতস্কির পক্ষে অবস্থান নিয়ে এভাবে ইতিহাস বিকৃত করে অধ্যাপক চৌধুরী বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীকে লজ্জায় ফেলে দিলেন।
১৯১৭ সনের অগাস্ট মাসে বলশেভিক পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের শুরুতে এই ‘Interborough’ নামক গ্রুপটি বলশেভিক পার্টির রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রথমবারের মতো বলশেভিক পার্টিতে যোগদান করেন। ষষ্ঠ কংগ্রেসের মাধ্যমে পার্টির ২২ সদস্য বিশিষ্ট যে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় সেখানে ‘Interborough’-এর মধ্য থেকে তিনজন কমিটিতে স্থান পান যার মধ্যে ত্রতস্কি অন্যতম। সারা বিশ্বব্যাপী ত্রতস্কিপন্থীরা কোথাও সরাসরি অথবা অন্যত্র কিছুটা আড়াল রেখে ত্রতস্কিকে মহান অক্টোবর বিপ্লবের একজন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত ও প্রচার করে থাকেন, বাংলাদেশেও তাঁর অনুসারীরা খুব পিছিয়ে নেই।
কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের সঠিক ইতিহাস বলছে অন্য কথা। বলশেভিক পার্টি ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, ত্রতস্কিও ‘সামরিক বিপ্লবী কমিটি’-এর সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান সঠিকভাবে পরিচালনার জন্যে বলশেভিক পার্টি পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে ১৯১৭ সালের ১৬ অক্টোবর এবং এই কমিটিই ছিল গণঅভ্যুত্থান পরিচালনার মূল কেন্দ্র। এবং এই কমিটিতে ত্রতস্কির নাম ছিল না- এ প্রসঙ্গে কমরেড স্তালিন তাঁর অক্টোবর বিপ্লব সংক্রান্ত লেখায় বলেন,
“এরপর ‘ভয়াবহ’ একটা কিছু ঘটল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে, অর্থাৎ ‘রহস্যজনকভাবে’ ‘অনুপ্রেরণাদাতা’, ‘প্রধান ব্যক্তিত্ব’, অভ্যুত্থানের ‘একমাত্র নেতা’, কমরেড ত্রতস্কি বাস্তব কেন্দ্র, যার দায়িত্ব ছিল অভ্যুত্থানকে নেতৃত্ব দেয়া- সেখানে স্থান পেলেন না। এই ঘটনাটিকে কীভাবে মেলানো যেতে পারে কমরেড ত্রতস্কির বিশেষ ভূমিকা-সংক্রান্ত বর্তমান ধারণাটির সাথে?”
তবে অক্টোবর বিপ্লবে ত্রতস্কির ভূমিকা নিয়ে কমরেড স্তালিন তাঁর অক্টোবর বিপ্লব সংক্রান্ত লেখায় আরও বলেন,
“অভ্যুত্থানে কমরেড ত্রতস্কির সন্দেহাতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মোটেও অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমাকে বলতেই হবে যে কমরেড ত্রতস্কি অক্টোবর অভ্যুত্থানে কোনো বিশেষ ভূমিকা পালন করেননি, সেটা সম্ভবও ছিল না; পেত্রগ্রাদ সোভিয়েতের প্রধান হিসেবে তিনি সংশ্লিষ্ট পার্টি কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করেছেনমাত্র – যা কমরেড ত্রতস্কির প্রতিটি পদক্ষেপকে পথপ্রদর্শন করেছিল”।
(Article published November 26, 1924)
লিঁও ত্রতস্কি মহান অক্টোবর বিপ্লবের মাত্র কয়েকমাস আগে বলশেভিক পার্টিতে যোগ দেন এবং তাঁর অতীত ও বর্তমানের অনুসারীরা এই বিষয়টি সুনিপুণভাবে এড়িয়ে যান। বলশেভিক পার্টির কর্মপ্রণালী ও ইতিহাস সম্পর্কে যাঁদের সঠিক ধারণা এবং পড়াশোনা আছে তাঁরা নিশ্চয় একমত হবেন যে পার্টিতে সদ্য যোগদান করা একজন নতুন সদস্যকে সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান পরিচালনার কেন্দ্রে অবশ্যই রাখা হবে না। এটা সত্য যে ত্রতস্কির কিছুটা জনপ্রিয়তা ছিল তৎকালীন রাশিয়াতে, কিন্তু তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীতে। মূলত বলশেভিক পার্টি তাঁকে দলে নিয়েছিল আপতিক অর্থে ঐ সময়ের রাশিয়ার প্রগতিপন্থী পেটি-বুর্জোয়াদের পার্টির আওতায় নিয়ে আসার একটা মাধ্যম হিসেবে। অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কয়েক মাসের মধ্যেই কমরেড লেনিনের সঙ্গে মতভিন্নতা শুরু হয়ে যায় এবং এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জার্মানির সঙ্গে ‘ব্রিস্ট-লিটভস্ক’ চুক্তি প্রসঙ্গ। ত্রতস্কি ‘Peoples Commissar of Foreign Affairs’ হিসেবে চুক্তিস্বাক্ষর করতে রাজি হননি, কিন্তু পরবর্তীতে কমরেড লেনিনের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও হস্তক্ষেপে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ত্রতস্কিপন্থীদের আরেকটি বড় প্রচার আছে ‘রেড আর্মি ও ত্রতস্কি’কে নিয়ে, অর্থাৎ তাঁরা প্রচার করেন বিপ্লবের পরে ত্রতস্কিই রেড আর্মি গড়ে তোলা এবং সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ ও গৃহযুদ্ধের সময় মূল ভূমিকায় ছিলেন। কিন্তু সঠিক ইতিহাস বলছে যে কমরেড স্তালিন ও কমরেড ভরশিলভ সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ ও গৃহযুদ্ধের সময় মূল ভূমিকায় ছিলেন এবং বলশেভিক পার্টি ও তাঁর কেন্দ্রীয় কমিটির কমান্ডেই এই ভূমিকা তাঁরা পালন করেছিলেন।
এটা মনে রাখা যথেষ্ট যে, ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মে, শ্বেত জেনারেল কোলচাকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ত্রতস্কি লাল বাহিনীর একটি অংশকে পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, অর্থাৎ কীনা উরাল অঞ্চল এর সকল কারখানা ও রেলপথসমেত কোলচাকের হাতে ছেড়ে দিয়ে। কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ত্রতস্কির প্রস্তাবের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কমিটি কোলচাককে উরাল থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য অগ্রাভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটাই ছিল কোলচাক-পর্বের সমাপ্তির শুরু। কিন্তু একইসাথে এটি পূর্বাঞ্চলে ত্রতস্কির যেকোনো ভূমিকারও সমাপ্তি ছিল। এবং শীঘ্রই তিনি দক্ষিণ রণাঙ্গণেও শ্বেত জেনারেল দানিকিনের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত হলেন। কিন্তু ত্রতস্কি ও তাঁর অনুসারীরা তাঁদের লিখিত বিপ্লবের ইতিহাসে এই সত্য কখনোই তুলে ধরেন না।
বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি, কিন্তু ত্রতস্কি আগের মতই লেনিন এবং বলশেভিক পার্টির নীতির বিরুদ্ধে আক্রমণ করতেই থাকলেন, এবং এবার তাঁর লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়নসমূহের কাজ নিয়ে। তাঁর মতে ট্রেড ইউনিয়নগুলো তাঁদের বর্তমান কাজ অর্থাৎ বিভিন্ন শিল্প, কল-কারখানা এবং দোকানে শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত ও তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করা বাদ দিয়ে যে কাজ করবে তা হচ্ছে সরকারের আওতাধীন থেকে সরকারি কাজকর্ম তদারকী, অর্থাৎ সরকারি প্রশাসক হিসেবে ভূমিকা পালন। এই লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে ত্রতস্কি দলের অভ্যন্তরে কিছু উপদলীয় গ্রুপের সৃষ্টি করেন এবং এমন একটা সময় তিনি বেছে নেন যেসময়টায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও গৃহযুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি এবং যেসময় বলশেভিক পার্টির একতাবদ্ধ থাকাটাই সবচেয়ে জরুরী। কমরেড লেনিন এই উপদলীয় অবস্থানকে চিহ্নিত করলেন অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে এবং বললেন,
“Even if the ‘new tasks and methods’ had been pointed out by Trotsky just as highly correctly as in reality they have been pointed out incorrectly throughout, …by such an approach alone Trotsky would have caused injury both to himself, to the Party, to the union movement, to the education of millions of members of the labor unions, and to the Republic.”
(V. I. Lenin, Collected Works, Vol. XXVI)
(অনুবাদ: যদিও ‘নতুন কর্ম ও পদ্ধতি’ ত্রতস্কি কর্তৃক চিহ্নিত হয়েছিল অত্যন্ত সঠিক হিসেবে, বাস্তবে তা আগাগোড়া ভ্রান্ত মর্মেই পরিগণিত হয়েছে … এই অবস্থান গ্রহণ করে ত্রতস্কি শুধু নিজেরই ক্ষতি করতেন না, সেই সাথে করতেন পার্টি, ইউনিয়ন আন্দোলন, শ্রমিক ইউনিয়নের লক্ষ লক্ষ সদস্যের শিক্ষাব্যবস্থা এবং প্রজাতন্ত্রেরও)।
অথচ ত্রতস্কির এদেশীয় দোসর আহমদ রফিক প্রলেতারিয়েত একনায়কত্ব বিষয়ে তালগোল পাকিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন প্রশ্নে তাঁর ভাষায় ‘ভিন্নমতাবলম্বী ত্রতস্কি’র পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে কমরেড লেনিনকে দোষ দিয়ে বলছেন তিনি প্রলেতারিয়েত একনায়কত্ব থেকে সরে গিয়ে পার্টির একনায়কত্বের পথে গিয়েছেন। আহমদ রফিকদের মতো স্বীকৃত ত্রতস্কিপন্থিদের এই ইতিহাস বিকৃতি আমাদের অবাক করে না।
ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত ত্রতস্কির অবস্থান ও মত পার্টিতে পরাজিত হয়। ১৯২৩ সালের দিকে ত্রতস্কি নতুনভাবে আক্রমণ শুরু করেন এবং এইবার সরাসরি কম্যুনিস্ট পার্টির কাঠামো, পার্টির কর্মপন্থা ও প্রণালী, পার্টির রাজনৈতিক লাইন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে। পার্টির অভ্যন্তরে ত্রতস্কির অনুসারীরা অভিযোগ করলেন তাঁদেরকে কথা না বলতে দেয়ার (এই নোংরা অভিযোগ এখনও পর্যন্ত ত্রতস্কিপন্থীরা করে থাকেন)। কিন্তু পার্টির সঠিক ইতিহাস বলছে ত্রতস্কিপন্থিদের এই অভিযোগটিও মিথ্যে। ১৯২৪ সাল থেকে শুরু করে ১৯২৭ সাল (পার্টি, কমিনটার্ন, এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত)- এই দীর্ঘসময় ত্রতস্কি ও তাঁর অনুসারীরা কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে তাঁদের ভিন্ন মতামত, বিতর্ক, প্রচারপত্র ইত্যাদি উপস্থাপন করেন।
পার্টির তরফ থেকেও বিভিন্নভাষায় এইসব বিতর্ক ও পার্টির অবস্থান ব্যাখ্যা করে হাজার হাজার কপি বই ছাপানো ও বিতরণ করা হয়েছিলো। ত্রতস্কিপন্থীরা এতদূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন যে পার্টি, পার্টির নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক লাইন, পার্টির সাধারণ সম্পাদক, পলিট ব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ সবাইকে লক্ষ্য করে বিষোদগার, বেআইনি ছাপাখানা থেকে প্রচারপত্র ছাপানো ও বিতরণ, তখন পর্যন্ত পার্টির সদস্য হয়নি এমন জনগোষ্ঠীর ভেতরেও প্রচার-প্রচারণা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড করেছিলেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯২৭ সালে লিঁও ত্রতস্কি পার্টি ও কমিনটার্ন-এর সব ধরনের কমিটি ও পদ থেকে বহিষ্কৃত হন, এবং এর কিছুদিন পর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯০০ সালের শুরু থেকে ১৯১৭ সালের অগাস্ট পর্যন্ত লিঁও ত্রতস্কি তৎকালীন বলশেভিক পার্টির কোন ধরনের সদস্য ছিলেন না – সঠিক ইতিহাসের আলোয় এখানে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ১৯১৭ সালের অগাস্ট মাসে ঘোষণা দিয়ে বলশেভিকদের সমস্ত নীতি ও মত গ্রহণ করে পার্টিতে যোগদান করেন, কিন্তু যোগদানের পরেও কমরেড লেনিন এবং বলশেভিক পার্টির বিরোধিতা অব্যাহত থাকে। এবং ১৯২৭ সালে বহিষ্কৃত হওয়ার পর অর্থাৎ পরবর্তী ১২ বছরের কিছু বেশী সময় তাঁর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হন কমরেড স্তালিন, যদিও এই আক্রমণ থেকে কমিনটার্ন, কম্যুনিস্ট পার্টি, এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কেউই বাদ যায় নি। কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির ওপর তার ঘৃণার মাত্রা এতোটাই তীব্র ছিল যে, ত্রতস্কি একে অভিহিত করতেন, ‘The New Aristocracy‘, কখনো ‘The New Bolshevik Bourgeoisie‘, আবার কখনো ‘New Bolshevik Aristocracy‘ অথবা ‘Privileged Bureaucracy‘ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে। ১৯৩৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখে লিখিত একটি নিবন্ধে ত্রতস্কি বলছেন,
“সুবিধাভোগী আমলাতন্ত্র … বর্তমানে সোভিয়েত সমাজের সবচেয়ে সমাজতন্ত্র-বিরোধী এবং সবচেয়ে গণতন্ত্র-বিরোধী অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে”।
এবং ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে লিখিত ‘The World Situation and Perspectives‘ প্রবন্ধে কমরেড স্তালিন ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুর্জোয়াদের সাথে তুলনা করে বলছেন,
“আমরা শাসক গোষ্ঠীকে দায়ী করছি নিজেদের নব্য অভিজাততন্ত্রে পরিণত করা, জনগণকে নিপীড়ন ও লুণ্ঠন করার দায়ে … আমলাতন্ত্রের উপরের স্তর প্রায় সেই ধরনের জীবন-যাপন করছে যেমনটি করছে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের সুখ-ভোগকারী বুর্জোয়ারা”।
ত্রতস্কি তাঁর জীবদ্দশায় একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন যিনি বলশেভিকবাদ এবং ফ্যাসিবাদকে পরস্পরের জমজ বলেছিলেন,
“Fascism is winning victory after victory and its best ally, the one that is clearing its path throughout the world, is Stalinism.”
(এপ্রিল, ১৯৩৮)
(ফ্যাসিবাদ একটির পর একটি বিজয় অর্জন করছে এবং তাদের প্রধানতম মিত্র হলো যারা বিশ্বজুড়ে নিজেদের পথ পরিষ্কার করে চলছে, সেই স্তালিনবাদ)
এবং
“…in fact, nothing distinguishes Stalin’s political methods from Hitler’s”
(১৭ মার্চ, ১৯৩৮)
(সত্যিকার অর্থে, স্তালিনের রাজনৈতিক পদ্ধতির সাথে হিটলারের কোনো পার্থক্যই নেই)।
ত্রতস্কি তাঁর জীবনের শেষ ১২টি বছর রাজনৈতিক সমালোচনার নামে এবং বিশ্বের প্রলেতারিয়েতের স্বঘোষিত নেতার দাবী নিয়ে কমরেড স্তালিন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে শুধু গালাগাল ও ঘৃণাই বর্ষণ করে গেছেন – তাঁর এই কাজে তৎকালীন জার্মান এবং জাপানী সাম্রাজ্যবাদ সরাসরি সহযোগিতা করেছিল। এই সরাসরি সহযোগিতার বিস্তারিত প্রমাণ উদঘাটিত হয়েছিল তিনটি বিখ্যাত ‘মস্কো ট্রায়াল‘-এ, যা সেইসময় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে পঞ্চম বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আঘাতস্বরূপ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নই একমাত্র দেশ যেখানে জার্মান নাৎসিবাদের অনুসারী কোন রাজনৈতিক দল ছিল না, এবং সেটা সম্ভব হয়েছিল তিনটি বিখ্যাত ‘মস্কো ট্রায়াল‘-এর জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের সেনাবাহিনী অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ দখল করে নেয় – এবং এই প্রতিটি দেশেই জার্মান নাৎসিবাদের অনুসারী রাজনৈতিক দল ছিল, এবং হিটলারের সেনাবাহিনী আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে এইসব দেশের পঞ্চম বাহিনী ও এঁদের রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
অথচ আশ্চর্যের বিষয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ইতিহাসবিদ অথবা অর্থনীতিবিদেরা এই সত্যটা চেপে যান। আর আমাদের বাংলাদেশে দুইজন পণ্ডিত ব্যক্তি যথাক্রমে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং আহমদ রফিক আমাদেরকে গল্প বলছেন যে, “স্তালিনের চাইতেও মেধাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও লেনিনের মৃত্যুর পর ত্রতস্কিকে চলে যেতে হয়েছিল দেশ ছেড়ে” – মেধাবী ত্রতস্কি ছিলেন জার্মান ও জাপানী সাম্রাজ্যবাদের দালাল এবং ‘মস্কো ট্রায়াল‘-এর দলিলগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে ত্রতস্কি এবং বুখারিন গংরা যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারেন তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশ জার্মান এবং জাপানী সাম্রাজ্যবাদের হাতে তাঁরা তুলে দিবেন, এই ছিল চ্যাম্পিয়ন দলদ্রোহী ত্রতস্কি ও বুখারিনের মেধার স্বাক্ষর – এর বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টি এবং এর প্রধান হিসেবে কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে মহান অক্টোবর বিপ্লবের অন্যতম প্রধান অর্জন ‘সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক‘-এর ক্রমাগত বিকাশের দিকে এগিয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে সেইদিন সম্ভব হয়েছিল জার্মান ও জাপানী সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করা, সম্ভব হয়েছিল সারাবিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের অধীন প্রতিটি পরাধীন ও উপনিবেশের আওতাধীন দেশগুলোতে মুক্তির সংগ্রামের আগুন জালিয়ে দেয়া, সম্ভব হয়েছিল শ্রমিক শ্রেণীর শাসক হিসেবে উত্তরণের, সম্ভব হয়েছিল রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণী ও তাঁর প্রধান হাতিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে প্রলেতারিয়েতের গণতন্ত্র চর্চার, সম্ভব হয়েছিল তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে কম্যুনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা, তাঁদের কাজের সমন্বয়, এবং যথাযথ দিকনির্দেশনা দেয়া।
এই প্রতিটি কাজের সঙ্গে কমরেড স্তালিনের নাম জড়িয়ে আছে – কিন্তু মেধার তুলনা করতে গিয়ে আমাদের দেশের দুই বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক চৌধুরী এবং আহমদ রফিক এই অর্জনগুলোর কিছুই দেখতে পান না। ত্রতস্কির অত্যন্ত অনুগত ছাত্র হিসেবে অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে লিখছেন,
“সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না ঠিকই, কিন্তু বাইরের বিশ্বে সম্পত্তিওয়ালাদের ভোগবাদী উজ্জ্বলতার খবর ভেতরের মানুষদেরকে চঞ্চল করেছে, বিশেষ করে পার্টি আমলাদের”।
অধ্যাপক চৌধুরী এই কথাগুলো বলেছেন ৬ মে ২০১৭ সালে।
আর লিঁও ত্রতস্কি ১৯৪০ সালে লিখেছেন,
“We accuse the ruling clique of having transformed itself into a new aristocracy, oppressing and robbing the masses… the higher layer of the bureaucracy lives approximately the same kind of life as the well-to-do bourgeoisie of the United States and other Capitalist Country”
(আমরা শাসক গোষ্ঠীকে দায়ী করছি নিজেদের নব্য অভিজাততন্ত্রে পরিণত করা, জনগণকে নিপীড়ন ও লুণ্ঠন করার দায়ে … আমলাতন্ত্রের উপরের স্তর প্রায় সেই ধরনের জীবন যাপন করছে যেমনটি করছে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের সুখ-ভোগকারী বুর্জোয়ারা)।
লিঁও ত্রতস্কি এবং অধ্যাপক চৌধুরীর লেখার মূল সুরে কী অসাধারণ মিল !!!
এই ধরনের ত্রতস্কিপন্থী লোকদেরকে সামনে রেখে যারা ‘অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি’ গঠন করলেন তাঁদের অন্যতম হচ্ছে সিপিবি, বাসদ, এবং বাসদ (মার্কসবাদী)। এই সংগঠনগুলোর প্রকাশিত দলিল থেকে কিছু উদাহরণ নিয়ে আমরা দেখবো শোধনবাদ এবং ত্রতস্কিবাদ কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
১)
“আমাদের দেশেও সময় আসছে, মার্কসবাদ তথা সমাজতন্ত্র কায়েম হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। এটা দ্রুত করা যায়, যদি আমরা মার্কসবাদ এবং লেনিনবাদ আত্মস্থ করে সৃজনশীলভাবে তা প্রয়োগ করতে শিখি।”
– ১৯৮৩ সালে এই লাইনগুলো লিখেছেন সিপিবির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোঃ ফরহাদ তাঁর ‘মার্কসবাদ জিন্দাবাদ’ নামক প্রবন্ধে।
ফলে বাংলাদেশে ‘দ্রুত সমাজতন্ত্র কায়েমের’ লক্ষ্যে এবং ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের’ উদ্দেশ্যে নিজেদের দল বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগদান করলেন। তাঁদের ১৯৮০ সালের রাজনৈতিক রিপোর্ট বলছে,
“সরকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে বাকশাল গঠনের পর কম্যুনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে তাদের সংগঠন বিলুপ্তি ঘটিয়ে বাকশালে যোগদান করে। পার্টির সিদ্ধান্ত অনুসারে পার্টির পক্ষ থেকে মোহাম্মদ ফরহাদকে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মনোনীত করা হয় এবং তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত বাকশালে যোগদান করেন’। তাঁদের এই বিলোপবাদি রাজনীতির শুরু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগের পর প্রথমে গণতন্ত্রী দল, আওয়ামী লীগ এবং তারপর ১৯৫৭ সাল থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মধ্যে কম্যুনিস্ট পার্টি নিজেদের অধিকাংশ শক্তিকে নিয়োজিত রেখে পেটি বুর্জোয়া রাজনীতির পুষ্টিসাধন করলো, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি হিসেবে সামন্ত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং দেশীয় শ্রেণীশত্রুদের বিরুদ্ধে পার্টিগতভাবে নিজেদের শক্তিকে বৃদ্ধি করতে তারা পারলো না। তাদের এই অক্ষমতার কারণে তৎকালীন পার্টির এবং পরবর্তীকালে একাধিক বিভক্ত পার্টির মধ্যে পেটি বুর্জুয়া ধ্যানধারণা ও সংশোধনবাদের প্রায় অনিয়ন্ত্রিত প্রভাব। এ জন্যই কম্যুনিস্ট পার্টি পেটি বুর্জুয়া রাজনৈতিক পার্টিগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে পেটি বুর্জুয়া পার্টিগুলোকে অধিকতর প্রগতিশীল করতে পারেনি, নিজেরাই পরিণত হয়েছে অধিকতর পেটি বুর্জোয়া পার্টিতে। শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি বিভিন্ন ফ্রন্টের মাধ্যমে গণসংযোগ স্থাপন করতে পারে, সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে পারে, কিন্তু অন্য শ্রেণীর একটি রাজনৈতিক পার্টির মধ্যে অনুপ্রবেশ করে যে তার চরিত্র পরিবর্তন করতে পারে না, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টির অথবা পরবর্তীকালের একাধিক বিভক্ত পার্টির ইতিহাসই তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করবে। ‘মার্কসবাদ জিন্দাবাদ‘ প্রবন্ধে মোঃ ফরহাদ সাহেব অত্যন্ত গর্ব নিয়ে উল্লেখ করছেন একটি ‘স্বীকৃতির‘ কথা যেটা তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা পেয়েছিলেন আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে, এবং সেই স্বীকৃতিতে শেখ সাহেব বলছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের জানি।… কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে যখন ছিলাম, তখনো আপনাদের অনেক কমরেডের সাথে আমাকে বছরের পর বছর কাটাতে হয়েছে। আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি। আপনাদের জনমত জানবার বুঝবার সুযোগ পেয়েছি। আপনারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে করেছেন, আপনাদের কর্মীরা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ সম্বন্ধে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না‘।”
(কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাষণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান)
পাঠক লক্ষ্য করুন সিপিবি কীভাবে শ্রমিকশ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ‘মার্কসবাদ–লেনিনবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের‘ নামে, এবং এর পাশাপাশি শ্রেণী সমন্বয় ও দল বিলুপ্তির রাজনীতি জায়েজ করে দলীয় কর্মীদের বিভ্রান্তির জালে ফেলার জন্যে নিজেদের ‘খাঁটি কম্যুনিস্ট চরিত্রও ত্যাগের‘ সার্টিফিকেট নিচ্ছেন একজন বুর্জোয়া নেতার কাছ থেকে। এবং এই সার্টিফিকেটের বলে বলীয়ান হয়ে তৎকালীন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক ‘কম্যুনিস্ট’ মোঃ ফরহাদ ’মার্কসবাদ জিন্দাবাদ‘ ধ্বনি দিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বলছেন,
“কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের আজ একই শত্রুর বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। মালিক শ্রমিক সম্পর্কের লড়াই এখন নয়”।
(তথ্যসূত্র: একতা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬)
একেই বলে শোধনবাদ – মুখে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের আহ্বান এবং বাস্তব কর্মে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের দালালী ও সেইসব সংগঠনে নিজেদের বিলুপ্তি সাধন।
সামরিক শাসন চলাকালীন সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদান করেন। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, এবং সেখানে জেনারেল জিয়ার মূল্যায়ন করে বলা হয়,
“জিয়া সামরিক শাসকের পদ গ্রহণ করায় স্বাধীনতা নস্যাৎ হওয়ার তথা চরম প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বিপদ হ্রাস পেয়েছে”।
(তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক প্রস্তাব, ১৯৭৭)
একইবছর ৪ জানুয়ারি তারিখে ময়মনসিংহ শহরে কম্যুনিস্ট পার্টির এক আঞ্চলিক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়,
“সরকারের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের খাল খনন কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে এই প্রকল্পে সহযোগিতার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানানো। পাশাপাশি কম্যুনিস্ট পার্টির ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সদ্যসরা এই প্রকল্পের কার্যক্রমে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করবে”
(তথ্যসূত্র: The Daily Observer, 12 January, 1977)।
“এছাড়াও কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মোজাফফর) জেনারেল জিয়াউর রহমানের ঘোষিত ১৯ দফা কর্মসূচির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করে। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে জেনারেল জিয়ার আস্থাবাচক হ্যাঁ/না ভোটের সময় কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মোজাফফর) হ্যাঁ-বাচক ভোট দেয়ার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়”
(তথ্যসূত্র: শতাব্দী পেরিয়ে, হায়দার আকবর খান রনো)।
সিপিবি কেন এই ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিল – এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য হায়দার আকবর খান রনো সিপিবির তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা অনিল মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এবং এর উত্তরে তিনি বললেন, “জিয়া হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের শেষ লিংক” অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য জিয়াকে ধরে রাখতে হবে (তথ্যসূত্র:ঐ)।
‘মার্কসবাদ জিন্দাবাদ‘ স্লোগানধারী সিপিবি ‘মার্কসবাদ–লেনিনবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের‘ নামে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দখলের মধ্যেও প্রগতিশীলতা খুঁজে পায়, তাঁদের কর্মসূচিতে ‘জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ‘ আবিষ্কার করে, এবং একজন জেনারেলের জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলের মধ্যে তাঁরা আবিষ্কার করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য ধরে রাখার তাগিদ।
সিপিবির এই পেটিবুর্জোয়া রাজনীতির উত্তর তাঁদের একজন পূর্বসুরী ও নেতা দিয়ে গেছেন,
“… সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে পার্টি এখানকার আপোষবাদী বুর্জোয়া নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করিয়াছে, শ্রমিক শ্রেণীকে স্বাধীনভাবে ক্ষমতা দখল করিতে আহ্বান জানায় নাই এবং পার্টি সংগঠন ও তাহার নেতৃত্বে একটি কঠোর শৃঙ্খলা সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টিতে পরিণত না হইয়া একটি সৌখিন পেটিবুর্জোয়া পার্টিতে পরিণত হইয়াছে”
(তথ্যসূত্র: ঢাকা জেলার কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অতীত যুগ, জ্ঞান চক্রবর্তী)
এবং তিনি নেতাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলছেন,
“… চূড়ান্ত হঠকারী ও বালসুলভ চাপল্যের পরিচালক”।
(তথ্যসূত্র: ঐ)
আওয়ামী লীগের ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শাসনকাল এবং পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে এসে সামরিক শাসক হিসেবে জেনারেল জিয়ার শাসন আমল – দুই পর্যায়েই সিপিবি তৎকালীন শাসক শ্রেণীর মধ্যে ‘প্রগতিশীল উপাদান‘ আবিষ্কার করেন। তৎকালীন শাসক শ্রেণীর প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং পরর্তীতে যতগুলো কালাকানুন ও সংশোধনী (১৯৭৫ সাল পর্যন্ত) এই সংবিধানে যুক্ত হয়েছে সিপিবি তা সমর্থন করেছিল ‘রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে‘, এবং সিপিবি সভাপতি মণি সিংহ লেনিনের ১০২তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন,
“মহান লেনিনের আদর্শ অনুসরণ করেই সরকার আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।“
(তথ্যসূত্র: দৈনিক সংবাদ, ২৩ এপ্রিল, ১৯৭২)
সিপিবির এই ঘৃণ্য ভূমিকার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র সম্পর্কিত সংশোধনবাদী তথা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বিরোধী ধারণা এবং অবশ্যই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদী রাজনীতির সফল প্রয়োগ। রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কস ও এঙ্গেলসকে তত্ত্বগত সংগ্রাম, এবং লেনিন ও স্তালিনকে তত্ত্বগত এবং প্রায়োগিক উভয় সংগ্রাম তীব্রভাবে পরিচালনা করতে হয়েছে। কেননা প্রলেতারিয়েত বিপ্লব ও ভাঁওতাবাজ সংশোধনবাদীদের বিপ্লবের অন্যতম পার্থক্যীকরণ রেখা হচ্ছে রাষ্ট্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি।
লেনিন বলেছেন,
“বুর্জোয়া বিশেষত পেটিবুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা মার্কসকে সংশোধন করে এভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করে যাতে রাষ্ট্র শ্রেণী সমূহের আপোষ মীমাংসার যন্ত্র হিসেবে উপস্থিত হয়। কিন্তু মার্কসের মতে রাষ্ট্র এ কাজের জন্য উদ্ভূত হয়নি কিংবা এ কাজ করা তার পক্ষে সম্ভবও নয়। বরঞ্চ রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণী বিরোধের অমিমাংসেয়তার ফল এবং বহিঃপ্রকাশ”।
ফলে ভাঁওতাবাজ ও সংশোধনবাদী সিপিবি রাষ্ট্রকে আপোষ মীমাংসার যন্ত্র মনে করে বিধায় বিভিন্নসময় শাসক শ্রেণীর দলগুলোর মধ্যে ‘প্রগতিশীল উপাদান ও পদক্ষেপ‘ খুঁজে পায় এবং একে বিকশিত করার জন্য সিপিবি মার্কা ‘কম্যুনিস্টরা‘ শাসক শ্রেণীকে সবধরনের সহযোগিতা করে থাকে, এবং তাতে অংশগ্রহণ করার জন্য শ্রমিকশ্রেণীকে আহ্বান জানায়। এছাড়াও শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন কার্যক্রম সিপিবির কাছে কখনো মনে হয় ‘প্রগতিশীলতা‘, আবার কখনোবা ‘দূর্বলতা‘, ‘ভুলভ্রান্তি‘ বা ‘কতক ক্ষতিকর কার্যকলাপ‘ হিসেবে প্রতিভাত হয়।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শাসক শ্রেণীর একটি দল হিসেবে আওয়ামীলীগের কর্মসূচিকে ‘সমাজতন্ত্রের অভিমুখী‘ আখ্যা দিয়ে দলের কর্মীদেরই শুধু নয় দেশের সমগ্র শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমজীবী মানুষকে এরা বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়; ১৯৭৪ সালের জরুরী অবস্থা আইন ও ১৯৭৫ সালের একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন, প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সরাসরি ভূমিকা পালন – এইসবই শক্তির ভারসাম্য রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থা বজায় রাখা কর্তব্য মনে করে সিপিবি।
২)
“… to develop a communist international free from old limitation and defects”
(পুরোনো সীমাবদ্ধতা আর ত্রুটিসমূহ থেকে মুক্ত একটি কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক গড়ে তোলা …)
এই বাক্যটি লিখিত হয়েছে অবিভক্ত বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল – বাসদের প্রকাশিত পুস্তিকা ‘Imperialist Globalisation’ এ (প্রকাশকাল: প্রথম কনভেনশন, ডিসেম্বর ২০০৯)।
অবিভক্ত বাসদের উল্লেখিত ‘পূরানো কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার‘ প্রসঙ্গের অবতারণা – একটি চমক জাগানিয়া বিষয়। এর কারণ হচ্ছে অভিবক্ত বাসদ তার জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত কোন প্রকাশনায় এই ‘সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার‘ কোন ব্যাখ্যা হাজির করেনি। মহান অক্টোবর বিপ্লবের অন্যতম অর্জন ছিল কমরেড লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টির উদ্যোগে ‘তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের’ প্রতিষ্ঠা। এবং লেনিন রচিত ‘বর্তমান বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতের করণীয়‘ (এটিই বিখ্যাত এপ্রিল থিসিস নামে পরিচিত) নামক থিসিসের ১০ নং থিসিসে বলা হয়,
“একটা নূতন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সোশ্যাল-শোভিনিস্ত এবং মধ্যপন্থীদের বিরুদ্ধে একটা বিপ্লবী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অবশ্যই আমাদের নিতে হবে”।
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় কেন বাসদ ‘সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার‘ প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। এর উত্তর খুঁজতে কিছুটা পেছনের ইতিহাসে আমাদের যেতে হবে, কারণ জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) থেকে বেরিয়ে এসে অভিবক্ত বাসদ (২০১৩ সালের পর বাসদ দুইভাগে বিভক্ত – এক অংশের নেতৃত্বে আছেন খালেকুজ্জামান ভুঁইয়া, এবং অপর অংশে মুবিনুল হায়দার চৌধুরী) গড়ে উঠেছিল ভারতের রাজনৈতিক দল SUCI এর প্রত্যক্ষ দিক নির্দেশনায় ও এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক শিবদাস ঘোষের তত্ত্বের ভিত্তিতে। যেহেতু বাসদের প্রকাশিত রাজনৈতিক সাহিত্যে তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের ‘সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার‘ কোন ব্যাখ্যা নেই, ফলে আমরা শিবদাস ঘোষের রচনার দ্বারস্থ হচ্ছি। SUCI এখন পর্যন্ত চার খণ্ডে শিবদাস ঘোষের নির্বাচিত রচনাবলী প্রকাশ করেছে এবং এখানেও তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের ‘সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার‘ কোন ব্যাখ্যা অথবা কোন রাজনৈতিক প্রবন্ধ নেই, তবে নির্বাচিত রচনাবলীর প্রথম খণ্ডের ১১ নং পৃষ্ঠায় একটি বাক্য প্রচণ্ড কৌতূহল উদ্দীপক, এবং সেটি হচ্ছে,
“আমাদের কর্মীরা জানেন যে, জার্মানি ও চীন সম্পর্কে সি পি এস ইউ’র (সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টি – লেখক) ভ্রান্ত বিশ্লেষণের কথা আমরা এক সময় বলেছিলাম”।
শিবদাস ঘোষের যে লেখা থেকে এই বাক্যটি নেয়া হয়েছে তা প্রকাশিত হয়েছিলো ২৪ জুলাই, ১৯৫৬ সালে তাদের পত্রিকা ’গণদাবী‘তে, এবং তার নির্বাচিত রচনাবলীর কোন খণ্ডেই সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির ‘জার্মানি ও চীন সম্পর্কে ভ্রান্ত বিশ্লেষণের‘ কোন ব্যাখ্যা আমরা পাইনি -তবে ‘আমরা এক সময় বলেছিলাম‘ এই বাক্যাংশটুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই অংশটুকুই আমাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলের মুখোমুখি করবে। সেই রাজনৈতিক দলিলটি হচ্ছে, ‘Theses on The National and International Situation‘ যা গৃহীত হয়েছিলো এপ্রিল, ১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত SUCI এর ‘First All-National Convention‘ এ। এই দলিলেই তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্কে শিবদাস ঘোষ ও SUCI তাদের ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরেছেন, এবং মজার বিষয় হচ্ছে SUCI তাদের এই দলিলটি এখন আর প্রকাশ করে না। এবং এই দলিলের ‘The Role of COMINTERN‘ অংশে তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে (১৯৩৫ সালে অনুষ্ঠিত) গৃহীত ‘United Front‘ পলিসির সমালোচনা করে বলা হলো যে,
ক)
“The objective conditions for Socialist Proletarian Revolution in many of the countries of Europe were fully matured during the last Great War but for the incompetence of the Comintern in leading the World proletarian revolutionary movement these conditions could not be utilised.”
(বিগত মহাযুদ্ধের সময় ইউরোপের বহু দেশেই সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারীয় বিপ্লবের পক্ষে বিষয়ীগত শর্তগুলো পূর্ণাঙ্গ পরিপক্বতা অর্জন করেছিল কিন্তু বিশ্ব প্রলেতারীয় বিপ্লবী আন্দোলনকে নেতৃত্বদানে কমিন্টার্নের অক্ষমতার দরুণ শর্তগুলোকে কাজে লাগানো যায় নি।)
খ)
“The acceptance of United Front as the general international political theory, as a result of which Anti-Fascist Democratic Front was accepted as the general international programme, was due to wrong analysis and miscalculation of world social force, as the programme itself was directed to maintain democracy more or less bourgeois in content whereas the world economy was in the phase of socialist revolution.”
(যুক্তফ্রন্টকে সাধারণ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করা, যার ফলস্বরূপ ফ্যাসিবাদ-বিরোধী গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সাধারণ আন্তর্জাতিক কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হয়- এর কারণ হলো বিশ্ব সামাজিক শক্তির ভুল বিশ্লেষণ আর হিসেব-নিকেশ, কেননা যখন বিশ্ব অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে ছিল তখন এই কর্মসূচিটিকে পরিচালনা করা হয়েছিল মর্মবস্তুর দিক থেকে কমবেশি বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে বজায় রাখার জন্য।)
গ)
“This wrong policy betrayed the cause of revolution in almost all the countries of Europe………… And thus the corrupt and incompetent Comintern utterly failed to prepare grounds for Socialist Proletarian Revolution in the highly developed countries of Europe at the most opportune moment by taking advantage of the already existing fully matured objective conditions ready for revolution.”
(এই ভুলনীতির কারণে ইউরোপের প্রায় সবদেশেই বিপ্লবের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হয়… এবং এভাবেই সবচেয়ে অনুকূল মূহুর্তে, যখন পরিপক্ব বিষয়ীগত শর্তসমূহ বিপ্লবের জন্য তৈরি অবস্থায় ছিল তখন দূর্নীতিগ্রস্থ ও অক্ষম কমিন্টার্ন এর সুযোগ নিয়ে ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারীয় বিপ্লবের জমিন প্রস্তুতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়।)
সঠিক এবং ইতিহাস সচেতন মার্কসবাদী–লেনিনবাদী রাজনৈতিক কর্মীরা নিশ্চয় একমত হবেন যে শিবদাস ঘোষ ও SUCI এর কমিন্টার্ন (তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক) প্রসঙ্গে এই ধরনের সমালোচনা ও ব্যাখ্যা একজন চ্যাম্পিয়ন দলত্যাগীর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের অনুরূপ প্রতিলিপি পাওয়া যায় – সেই দলত্যাগীটি হচ্ছেন লিঁও ত্রতস্কি। শিবদাস ঘোষ ও SUCI এর তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিককে নিয়ে এই ধরনের ত্রতস্কিপন্থী ব্যাখ্যার কিছু জবাব সঠিক ইতিহাসের আলোকে আমরা তুলে ধরবো, তবে তার আগে এই ব্যক্তির কিছু রাজনৈতিক পরিচিতি তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক।
শিবদাস ঘোষ এর রাজনীতিতে হাতে খড়ি হয় Revolutionry Socialist Party, India (RSP) এর মাধ্যমে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসবে আরএসপি কারা গঠন করেছিলেন? উনিশ শতকের নব্বই এর দশকে মধ্যশ্রেণীভূক্ত শিক্ষিত ভারতীয় যুবকদের একটি অংশের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা অনেকখানি তীব্র হয়। শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ শাসনের বৈষম্যমূলক ব্যবহার, চাকুরী ও অপরাপর ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমানের প্রতিযোগিতা এবং সেই প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে ব্রিটিশের ভূমিকা, চাকুরী, ব্যবসা ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা নিতান্ত সীমিত থাকা ইত্যাদি কারণসমূহ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটা বিক্ষোভ মধ্যশ্রেণীর মধ্যে ধূমায়িত হতে থাকে। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন্যে কোন সংগ্রাম কংগ্রেসের নেতৃত্বের দ্বারা সম্ভব ছিল না। কারণ কংগ্রেস সেই সময়ে ব্রিটিশ শাসনের সাথে আপসের মাধ্যমে ছোটোখাটো কিছু কিছু দাবীদাওয়া আদায়ের আন্দোলন ব্যতীত অন্যকোন আন্দোলনে একেবারেই সমর্থ অথবা আগ্রহশীল ছিল না।
মধ্যশ্রেণীর উপরোক্ত অংশের যুবকদের মধ্যে কংগ্রেস নেতৃত্বের এই মনোভাব ও নীতি একটা বিদ্রোহের ভাব জাগ্রত করে এবং তাঁরা অনেকে কংগ্রেসের কাঠামোর মধ্যে থাকলেও সন্ত্রাসবাদী পথে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করতে উদ্যত হন। তৎকালে এই যুবকরা সকলেই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা তখন যথেষ্ট প্রবল ছিল এবং সে কারণেই বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারা ও রচনাবলী তাঁদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। ‘আনন্দমঠ’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, ‘অনুশীলন’ ইত্যাদির প্রভাবে সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ভারতে হিন্দু প্রাধান্য ও সনাতন ধর্মের প্রতিষ্ঠাকেই তাঁরা নীতি হিসেবে গ্রহণ করে ছিলেন। কিন্তু উনিশ শতকের শেষ দিকে শিক্ষিত হিন্দু সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের একটা সাম্প্রদায়িক চরিত্র থাকলেও বঙ্কিমচন্দ্রের সন্ত্রাসবাদের সাথে তার উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল এই যে, তা মূলতঃ পরিচালিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। হিন্দু মধ্যশ্রেণীর এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ক্রমশঃ বিস্তার লাভ ও শক্তি অর্জন করতে থাকে এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর তা এক প্রবল আন্দোলনে পরিণত হয়। এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনকারীরা অনেকেই কংগ্রেসের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুগত থাকলেও কংগ্রেসের নীতির সাথে তাঁদের কার্যকলাপকে কখনই সমর্থন করেননি। শুধু তাই নয়- তাঁরা এর যথাসাধ্য বিরুদ্ধাচরণই করেছিলেন। ১৯৩০ এর দশকে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পর প্রায় চল্লিশ বছর স্থায়ী এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এসময়ে বহুসংখ্যক সন্ত্রাসবাদী নেতা ও কর্মীরা ভারতের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী ছিলেন। তাঁদের একটা বিরাট অংশ মার্কসবাদ গ্রহণ করে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল দু’টো সংগঠনের মাধ্যমে – একটি হচ্ছে ‘অনুশীলন সমিতি’ এবং অপরটি ‘যুগান্তর সমিতি’। অনুশীলন সমিতির একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং যুগান্তর সমিতির প্রায় পুরোটাই ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি তথা সিপিআইতে যোগদান করেন। এই অনুশীলন সমিতির বেশীরভাগ নেতা-কর্মীরা মিলেই ১৯৩৯ সালের দিকে আরএসপি (Revolutionry Socialist Party, India) গঠন করেন এবং আরএসপি শুরু থেকেই তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির বিভিন্ন নীতি ও কর্মকৌশলের ঘোরতর সমালোচক ও সরাসরি বিরোধী ছিলেন।
যদিও অফিসিয়ালি তাঁরা কখনো ঘোষণা করেননি যে তাঁরা ত্রতস্কির অনুসারী কিন্তু তৎকালীন রাজনীতির ওপর তাদের সমস্ত মতামত, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছিল ত্রতস্কির ব্যাখ্যার অনুরূপ, এবং পরাধীন ভারতে সেই ১৯৪০ সালে ত্রতস্কির ‘Permanent Revolution’ তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করলেন ‘সমাজতান্ত্রিক’। শিবদাস ঘোষ ভারত বিভাগের পর আরএসপির সাথে সম্পর্কের ছেদ ঘটিয়ে ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে SUCI নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন। কিন্তু আরএসপির মূল রাজনৈতিক লাইনের সাথে মিল রেখে ভারতের বিপ্লবের স্তর সম্পর্কে বললেন,
“…the only way of reachingour goal can be obtained through overthrow of the bourgeoisie in power which is a programme for socialist revolution.”
(আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর একমাত্র পথ কেবল ক্ষমতায় থাকা বুর্জোয়াজীর উচ্ছেদের মারফতেই অর্জিত হতে পারে – এটা হলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি)
এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত টানলেন,
“So long ourimmediate enemy was British Imperialism but with the transfer of political power to therepresentatives of Indian bourgeoisie, the British Imperialism responsible for the directexploitation of the Indian masses has moved to the background …”
(এ পর্যন্ত আমাদের আশু দুশমন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, কিন্তু ভারতীয় বুর্জোয়াজীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সাথে সাথে ভারতীয় জনগণকে প্রত্যক্ষ শোষণের জন্য দায়ী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ পশ্চাদপটে সরে গেছে।)
ত্রতস্কিপন্থী থেকে ‘মার্কসবাদীতে’ পরিণত হওয়া শিবদাস ঘোষ তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু সংগঠন আরএসপির মতই ‘Permanent Revolution’ তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করলেন ‘সমাজতান্ত্রিক’। এবং মজার বিষয় হচ্ছে যে ‘মার্কসবাদী’ শিবদাস ঘোষ ত্রতস্কিপন্থার সমালোচনার নামে ত্রতস্কিপন্থী সংগঠনগুলো সম্পর্কে সাফাই গেয়ে ১৯৪৮ সালের থিসিসে বলছেন,
ক)
“The officially recognised Communist Parties also are to change their attitude towards the ultraists and Trotskites. Their hostile and unnecessary bitter criticism wasin no way less responsible for pushing the permanentists towards the enemy camp. It is a strategical blunder.”
(আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর উচিত উগ্রবাদী এবং ট্রটস্কিপন্থীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা। তাদের শত্রুতামূলক এবং অপ্রয়োজনীয় তিক্ত সমালোচনা নিরন্তরতাবাদীদের শত্রু শিবিরে ঠেলে দেয়ার জন্য কোনো অংশেই কম দায়ী নয়। এটি একটি কৌশলগত ভুল।)
খ)
“Surely the Fourth Internationalists have got a role against the capitalist world.”
(নিশ্চয়ই চতুর্থ আন্তর্জাতিকের পুঁজিবাদী দুনিয়ার বিরুদ্ধে পালন করার মতো ভূমিকা রয়েছে।)
গ)
“…a generous call from the Cominform to all the bonafide Socialists, Communists, Democrats for cementing closest unity against the menace of World-reaction.”
(…সকল আন্তরিক সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট, গণতন্ত্রীদের প্রতি বিশ্ব-প্রতিক্রিয়ার হুমকির বিরুদ্ধে ঘনিষ্ঠতম ঐক্য গড়ে তোলার জন্য কমিনফর্মের একটি উদার আহ্বান।)
এই হচ্ছে ‘মার্কসবাদী’ শিবদাস ঘোষের মূল রাজনৈতিক চেহারা, যা তার এদেশীয় দুই ছাত্র খালেকুজ্জামান ভুঁইয়া, এবং মুবিনুল হায়দার চৌধুরী সযত্নে আড়াল করেন।
তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের (কমিন্টার্ন) সপ্তম কংগ্রেসে গৃহীত ‘ইউনাইটেড ফ্রন্ট‘ পলিসির সমালোচনা করতে গিয়ে শিবদাস ঘোষ বললেন,
ক) এই পলিসির কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে সমগ্র ইউরোপ ও বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করা সত্ত্বেও ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ সম্পন্ন হয়নি,
খ) এই পলিসি গ্রহণের মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতি ও শ্রেণী অবস্থানের ভুল ব্যাখ্যা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ফ্রন্ট গড়ে উঠে – যা বিশ্ব বিপ্লবের পরিস্থিতি ধ্বংস করে, এবং
গ) সেই কারণে তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক একটি দুর্নীতিগ্রস্থ ও অসমর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
মহান অক্টোবর বিপ্লবের অন্যতম অর্জন কমিন্টার্নকে নিয়ে ১৯৪৮ সালে ‘মার্কসবাদী’ শিবদাস ঘোষ ও ভারতের ‘চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘একমাত্র’ ‘কম্যুনিস্ট সংগঠন’ SUCI এর এই ছিল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। ফলে এহেন শিবদাস ঘোষ যখন বলেন জার্মানি সংক্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির বিশ্লেষণ ভুল এবং তার মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা বাসদের ‘পূরানো কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার‘ প্রসঙ্গের অবতারণা – সৎ ও ইতিহাস সচেতন মার্কসবাদী-লেনিনবাদি রাজনৈতিক কর্মীদের অবাক করে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে তৎকালীন জার্মানির রাজনীতিতে জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টি, কমিন্টার্ন, ও লিঁও ত্রতস্কির ভূমিকার কিছু উদাহরণ এখানে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক হবে।
ত্রতস্কিপন্থী সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংগঠন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ও এখন পর্যন্ত, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল দেখে ত্রতস্কিপন্থী থেকে ‘মার্কসবাদী’ বনে যাওয়া অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন তৎকালীন জার্মানির রাজনীতিতে জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টির ভূমিকা নিয়ে কমিন্টার্ন ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে সরাসরি দোষারোপ করেন।
১৯৩০ সালে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিশ্লেষণ করে কমরেড স্তালিন বলছেন,
“আড়াই বছর আগেকার পুঁজিবাদী দেশগুলোর অবস্থা মনে করে দেখুন। প্রায় সকল পুঁজিবাদী দেশের শিল্পোৎপাদন ও বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি। প্রায় সকল কৃষিপ্রধান দেশে কাঁচামাল ও খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি। পুঁজিবাদের পূণ্যভূমি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মাথার উপর পবিত্র চক্র। ‘সমৃদ্ধি’র গুণগান সমৃদ্ধ জয়ঢাক। ডলারের সামনে নতজানু অবস্থা। নয়া প্রযুক্তি ও পুঁজিবাদী যুক্তি বিস্তারের সম্মানে প্রশংসাধ্বনি। পুঁজিবাদের ‘পুনরুজ্জীবন’ ও পুঁজিবাদী স্থিতিশীলতার প্রক্রিয়ায় অনড় দৃঢ়তার যুগ-ঘোষণা। সোভিয়েত ভূমির ‘অনিবার্য ধ্বংসে’র, ইউএসএসআর-এর ‘অনিবার্য পতনে’র বিষয়ে ‘সার্বজনীন’ চিৎকার আর গোলমাল। এসবই গতকালকের ঘটনা”।
এবং আড়াই বছর পরের অবস্থা তুলে ধরে কমরেড স্তালিন বলছেন,
“বর্তমানে পুঁজিবাদের প্রায় সকল শিল্পায়িত রাষ্ট্রেই অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা যাচ্ছে। সকল কৃষিপ্রধান দেশেই দেখা দিয়েছে কৃষি-সঙ্কট। ‘সমৃদ্ধি’র পরিবর্তে ব্যাপক দারিদ্র্য এবং বেকারত্বের ব্যাপকবৃদ্ধি। কৃষিতে ঊর্ধ্বগতির বদলে কৃষক সমাজের বিপুল অধিকাংশের ধ্বংস। সাধারণভাবে পুঁজিবাদ ও বিশেষভাবে উত্তর আমেরিকান পুঁজিবাদের শক্তিমত্তা সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণাগুলো ধসে পড়ছে। ডলারের সম্মানে গুণগান সমৃদ্ধ জয়ঢাক এবং পুঁজিবাদী যুক্তিবিস্তার ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। পুঁজিবাদের ‘ভুলগুলো’ সম্পর্কে হতাশাজনক হাহাকার বেড়েই চলেছে। ইউএসএসআর-এর ‘অনিবার্য পতনে’র বিষয়ে ‘সার্বজনীন’ চিৎকারের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে ‘দেশটিকে’ শাস্তিপ্রদানের ‘সার্বজনীন’ বিষাক্ত হিশহিশ ধ্বনি- যে দেশটি বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের রাজত্বকালে তার নিজের অর্থনীতিকে বিকশিত করে তোলার স্পর্ধা দেখায়”।
জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এইরকম ভয়াবহ সংকট ফ্যাসিবাদের পথ উন্মুক্ত করে দেয় – এবং এই দুই দেশে ক্ষমতার অংশীদার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও এদের রাজনীতি ফ্যাসিবাদীদেরকে ক্রমশঃ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে যায়। জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিভিন্ন ধরনের ফ্যাসিবাদী সংগঠন গড়ে ওঠে এবং জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলন সংগ্রাম কঠোর হস্তে দমন করা হয় – এমনকী বিভিন্ন কল কারখানায় গড়ে ওঠা শ্রমিকদের জঙ্গি লাল ফ্রন্টকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় এবং অনেক জায়গায় শ্রমিকদের এইসব লড়াকু সংগঠনগুলোকে আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলো যেভাবে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল এবং এর ফলশ্রুতিতে কমরেড লেনিন এদেরকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘Social Patriot’ ও ‘Social Chauvinist’ হিসেবে, ঠিক একইভাবে তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক ১৯৩০ এর দশকে এইসব সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও এদের নেতৃত্বকে ‘Social Fascist’ নামে অভিহিত করেন। তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের এই ব্যাখ্যা ত্রতস্কি মেনে নিতে পারেনি এবং এর বিপরীতে তিনি বললেন,
“যদি কমিন্টার্ন ১৯২৯ সাল থেকে, এমনকী ১৯৩০ কিংবা ১৯৩১ সাল থেকেইতার নীতির ভিত্তিমূলে সোশ্যাল-ডেমোক্রেসি ও ফ্যাসিবাদ, আরো সঠিকভাবে বললে ফ্যাসিবাদ ও সোশ্যাল-ডেমোক্রেসির মধ্যে বিষয়ীগত অসঙ্গতিকে স্থাপন করত; যদি এর ওপর ভিত্তি করে যুক্তফ্রন্টের পদ্ধতিগত ও ধারাবাহিক নীতি গড়ে তুলত, তাহলে জার্মানী কয়েকমাসের মধ্যেই প্রলেতারীয় প্রতিরক্ষার শক্তিশালী কমিটি, সম্ভাবনাময় শ্রমজীবী মানুষের সোভিয়েতের নেটওয়ার্ক দ্বারা ঘেরাও হয়ে যেত”।
(Leon Trotsky, The Militant, March 10, 1934.)
হিটলার কর্তৃক জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের জন্য ত্রতস্কি দায়ী করছেন তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের নীতি ও সিদ্ধান্তকে, এবং তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ‘Social Fascist’ বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু ত্রতস্কি সেদিন জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টির কিছু ঐতিহাসিক সত্যকে আড়াল করে নিজের পেটি বুর্জোয়া মেনশেভিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হাজির করেন।
১৯৩০ সালে জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টির কিছু সাংগঠনিক দূর্বলতা ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই পার্টির রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে কমিন্টার্ন বলছে,
“হিটলারের ক্ষমতাগ্রহণের ঠিক আগের পর্বে, কম্যুনিস্ট পার্টি ব্যাপক জনগণের মধ্যে প্রবেশে, এমনকী সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট, সংস্কারপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন এবং ‘রিপাবলিকান ফ্ল্যাগ’ সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারে সফল হয়েছিল – এর কারণ হলো জরুরী ডিক্রির বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। পার্টির কর্তৃত্ব অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছিল, এবং সংস্কারপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলো বিরোধী দলীয় লাল ট্রেড ইউনিয়ন ও কম্যুনিস্টদের দ্বারা পরিচালিত ধর্মঘটগুলোতে অংশগ্রহণ করা শুরু করেছিল। এভাবে, কম্যুনিস্টদের পাশাপাশি সংস্কারপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যরা, এমনকী জাতীয় সমাজতন্ত্রীরাও বার্লিনের পরিবহন ধর্মঘট কমিটিতে অংশগ্রহণ করেছিল”।
এছাড়াও কম্যুনিস্ট পার্টি –
১) ১৯২৫ সনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে প্রস্তাব দিয়েছিল ‘Monarchist’ বিপদের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনের জন্য,
২) ১৯২৫ সনে বার্লিন মিউনিসিপালিটিতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও কম্যুনিস্ট পার্টির যৌথভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতাথাকার কারণে, কম্যুনিস্ট পার্টি প্রস্তাব দিয়েছিলো শ্রমিকদের জন্য একটি ‘Common Program of Action’ গড়ে তোলার জন্য,
৩) জার্মান রাজপরিবারকে তাদের সম্পত্তি না ফিরিয়ে দেয়ার দাবীতে জনগণকে সম্পৃক্ত করে যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ১৯২৬ সনে কম্যুনিস্ট পার্টি আবারো প্রস্তাব দেয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে,
৪) ১৯২৮ সনে এসে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে প্রস্তাব দেয়া হয় যৌথ ভাবে মে দিবস পালন এবং যুদ্ধ জাহাজ ও নতুন সমরাস্ত্র নির্মাণের বিরুদ্ধে ‘Joint Anti-Militarist Action’ এই নামে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য, এবং
৫) ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ সনে পর্যন্ত কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে বহুবার প্রস্তাব দেয়া হয় শ্রমিকের মজুরী হ্রাসের প্রস্তাবের বিপক্ষে যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য।
কিন্তু ১৯২৫ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিটি প্রস্তাব সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নাকচ করে দেয় এবং জার্মানির তৎকালীন বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেই রাজনৈতিক আঁতাত বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকী ভন পেপেনের প্রুশিয়ান সরকার যখন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ক্ষমতার অংশিদারিত্ব থেকে বিতাড়ন করেন, এবং ফ্যাসিস্তদের ‘Storm Troops’ বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ ধর্মঘট কর্মসূচির প্রস্তাব কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে দেয়া হয় সেটাও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নাকচ করে দেয়। ৩০ জানুয়ারি ১৯৩৩ তারিখে হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের দিন সাধারণ ধর্মঘট কর্মসূচি পালনের প্রস্তাবও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নাকচ করে দেয়, এবং ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে রাইখস্তাগে (জার্মান পার্লামেন্ট- লেখক) অগ্নিকাণ্ডের প্রতিবাদে যৌথভাবে সাধারণ ধর্মঘট কর্মসূচি পালনের প্রস্তাবও নাকচ করা হয়। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এইসব কর্মকাণ্ডের পরও তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক যখন তাঁদেরকে ‘Social Fascist’ বলে সেটা ত্রতস্কি গ্রহণ করতে পারেন না, উল্টো হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের দায় কম্যুনিস্ট পার্টি ও কমিন্টার্নের পলিসির ওপর চাপিয়ে দেন, এবং সেইসঙ্গে তার অনুগত ছাত্র ‘মার্কসবাদী’ শিবদাস ঘোষ ১৯৪৮ সালে আবিষ্কার করেন যে জার্মানি সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টি এবং কমিন্টার্নের বিশ্লেষণ ভুল ছিল – সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক একটি দুর্নীতিগ্রস্থ ও অসমর্থ প্রতিষ্ঠান।
১৯৩০ এর দশকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলোর এই ধরনের রাজনীতির গভীরতা আরও ভালোভাবে তুলে ধরেছেন একজন বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক নেতা যিনি ‘Left Marxist’ হিসেবে সুপরিচিত, তিনি হচ্ছেন অটো বাওয়ার। তিনি ‘New York Times’ পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে (যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪ তারিখে) অস্ট্রিয়ান ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটর ডলফাসকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কীভাবে রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা করেছিলো তা তুলে ধরেছেন – এর মধ্য দিয়েও জার্মানিতে ফ্যাসিস্তদের ক্ষমতায় আরোহণে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির রাজনৈতিক সহযোগিতার চিত্র ফুটে উঠে। অটো বাওয়ার বলেছেন,
“জার্মানীতে হিটলারের বিজয়ের পর থেকে, যখন রাইখস্ট্যাগ ‘নির্বাচন’ জার্মান নাৎসিদের হাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে দিল, আমাদের পার্টি সরকারের সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল … মার্চের প্রথমার্ধে আমাদের নেতৃবৃন্দ ডলফাসের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন, এবং একটি সাংবিধানিক সমাধানে তাকে রাজি করানোর ব্যাপারে বারংবার চেষ্টা করেছিলেন। মার্চের শেষে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের নেতা ড. ডেনেনবার্গকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, এপ্রিলের শুরুতে তিনি সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে আমাদের সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করবেন। এই প্রতিশ্রুতি তিনি কখনোই রক্ষা করেন নি, কেননা এপ্রিলের প্রথমেই তিনি ফ্যাসিবাদীদের শিবিরে যোগ দিলেন … এবং সমাজতন্ত্রীদের কারো সাথেই কথা বলতে অস্বীকার করলেন। যখন বললেন যে তিনি বর্তমান নেতাদের সাথে দেখা করতে পারবেন না তখন আমরা তাকে অন্য আলোচনাকারী প্রেরণের প্রস্তাব দিলাম। তিনি তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। আমরা যখন তার সাথে দেখা করতে পারলাম না, তখন আমরা অন্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে আলাপ আলোচনার চেষ্টা করলাম। সত্যি কথা বলতে, আমরা চেষ্টার কোনো ত্রুটিই রাখলাম না। আমরা প্রেসিডেন্ট মিকলাসের কাছে গেলাম … তারপর কেরানী-মার্কা রাজনীতিকদের মধ্যে যাদেরকে চিনতাম তাদের দ্বারা চেষ্টা করলাম। কিন্তু সবই বৃথা গেল ডলফাসের বেপরোয়া প্রত্যাখ্যানে, যিনি আরেকবারের জন্য সমাজতন্ত্রীদের কোনো কথাই শুনতে চাইলেন না। ধার্মিক সমাজতন্ত্রীদের একটি গ্রুপ ক্যাথলিক গণতন্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ে চার্চকে হস্তক্ষেপ করতে প্ররোচনা যোগাল। সেটিও ব্যর্থ হলো”।
একই সাক্ষাৎকারে অটো বাওয়ার আরও বলেছেন,
“আমরা সর্বোচ্চ আপোষের প্রস্তাব দিলাম, যা একটি গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী পার্টি কখনো দিয়েছে। আমরা ডলফাসকে জানিয়ে রাখলাম যে তিনি যদি সংসদের মাধ্যমে শুধু একটি বিল পাশ করেন তাহলে আমরা দুই বছরের জন্য সরকার কর্তৃক সংসদ ছাড়াই ডিক্রির মাধ্যমে শাসন চালানোর পদক্ষেপকে মেনে নেব, দুইটি শর্তের ভিত্তিতে, একটি ছোট সংসদীয় কমিটি – যেখানে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে – ডিক্রির সমালোচনা করতে পারবে এবং একটি সাংবিধানিক আদালত – সংবিধান লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা – পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে”।
ত্রতস্কি এবং ত্রতস্কিপন্থীরা কখনোই সোশ্যাল ডেমোক্রেসির আসল রাজনৈতিক চরিত্র বুঝতে পারেন না নিজেদের পেটি বুর্জোয়া মেনশেভিক রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে। যদিও সেই মতাদর্শ ‘মার্কসবাদী’ কথামালার মোড়কে ঢাকা থাকে। এরা বিশ্বাস করেন সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সাথে যৌথভাবে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব, অথবা বিশ্বাস করেন এদের সাথে শ্রমিকদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক দাবী নিয়ে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে সংগ্রাম করা যায়।
শিবদাস ঘোষ ‘তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক একটি দুর্নীতিগ্রস্থ ও অসমর্থ প্রতিষ্ঠান’ প্রমাণ করতে গিয়ে আরও বললেন যে, ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের’ ‘Objective Condition’ বিরাজ করা সত্ত্বেও কমিন্টার্নের ভুল নীতি ও কৌশলের কারণে তা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। একই অভিযোগ কঠোর ভাষায় ত্রতস্কি ও তার অনুসারীরা ১৯৩০ দশকেও তুলেছিলেন। কিন্তু সঠিক ইতিহাস আবারো শিবদাস ঘোষকে ত্রতস্কির অনুসারী হিসেবেই প্রমাণ করছে। কমরেড লেনিন বহু আগেই দেখিয়েছেন একটি সমাজে বিপ্লবী পরিস্থিতি কোন কোন শর্তসাপেক্ষে একটি পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়, পরিপক্ব হয়, বিপ্লব বিজয়ী হয়। ফলে লেনিনবাদ অনুসারে,
“বিপ্লবের মূলসূত্র যা সমস্ত বিপ্লবের দ্বারা, বিশেষত বিশ শতকের তিনটি রুশ বিপ্লবের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হল এই: পুরাতন কায়দায় জীবনযাপন অসম্ভব- শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের এই উপলব্ধি এবং তাঁকে পরিবর্তনের দাবীই বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। শোষকেরা যাতে পুরাতন কায়দায় জীবনযাপন ও শাসন করতে না পারে, বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার জন্য সেটা অবশ্য প্রয়োজনীয়। একমাত্র সেই পরিস্থিতিতেই বিপ্লব জয়লাভ করতে পারে যখন ‘নিম্ন শ্রেণীরা’ পুরাতন কায়দায় জীবনযাপন করতে চায় না, এবং ‘উচ্চ শ্রেণীরা পুরাতন কায়দায় আর শাসন চালাতে পারে না। এই সত্যটিকে অন্যভাবেও প্রকাশ করা যায়: একটা জাতীয় সংকট (যা শোষক ও শোষিত উভয়কেই স্পর্শ করে) ব্যতিরেকে বিপ্লব অসম্ভব। এর থেকে এটাই দাঁড়ায় যে, বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার জন্য যা অবশ্য প্রয়োজনীয় প্রথমতঃ তা হলো এই যে, মজুরদের মধ্যে অধিকাংশ (বা অন্তত পক্ষে শ্রেণী সচেতন, চিন্তাশীল এবং রাজনীতিগত ভাবে সক্রিয় মজুরদের অধিকাংশকে) বিপ্লবের প্রয়োজন পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হবে, এবং তার জন্য প্রাণ দিতে তাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। দ্বিতীয়তঃ শাসক শ্রেণীসমূহকে এমন একটি সরকারী সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হবে যা জনগণের সব থেকে পশ্চাৎপদ অংশকেও রাজনীতিতে টেনে আনবে (একটি সত্যিকার বিপ্লবের লক্ষণ হল এই যে, সে সময়ে এতদিন পর্যন্ত দূরে সরে থাকা সেই মজুর ও নিপীড়িত জনগণের সংখ্যা দ্রুতগতিতে দশ গুণ এমনকি শত গুণ বাড়িয়ে তোলে যারা একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে সক্ষম), সরকারকে দুর্বল করবে এবং বিপ্লবীদের দ্বারা তার দ্রুত উচ্ছেদকে সম্ভব করবে।”
(লেনিন, Leftwing Communism, an Infantile Disorder)।
লেনিনবাদের এই মহান শিক্ষায় সজ্জিত হয়ে তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক ১৯৩০ এর দশকে জার্মানির রাজনৈতিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে বলছেন,
“এই সকল শর্ত কি ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে পরিপক্ব হয়েছিল? না। বুর্জোয়াজীর পুরো অংশটা, প্রলেতারীয় বিপ্লবের হুমকির মুখে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য সত্ত্বেও বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল। পেটি বুর্জোয়াজীর বৃহদাংশ হিটলার কর্তৃক প্রতিনিধিত্বকৃত বুর্জোয়াজীকে অনুসরণ করছিল, যিনি তাদেরকে ‘মহান’ পুরাতন জার্মানী ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যেখানে পেটি বুর্জোয়াজী কম বেশি সহনশীল পরিবেশে বসবাস করতো। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, যাদেরকে তখনো অনুসরণ করছিল শ্রমিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তাদের দ্বারা প্রলেতারিয়েতের মধ্যেও ভাঙন সৃষ্টি হয়েছিল। সুতরাংশোষকরা তখনও টিকে থাকতে, শাসন চালাতে এবং শ্রমিক শ্রেণীকে আগের মতোই, যদিও নতুন ফ্যাসিবাদী পদ্ধতির সাহায্যে শোষণ করতে সক্ষম হচ্ছিল।”
এছাড়াও কমিন্টার্নের নির্বাহী কমিটির প্রেসিডিয়াম ১৯৩০ এর দশকে জার্মানির রাজনৈতিক অবস্থার মূল্যায়ন করে বলছেন,
“এই পরিস্থিতিতে প্রলেতারিয়েত এমন একটি অবস্থানে ছিল যেখানে তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে আশু ও নিষ্পত্তিমূলক আঘাত সংগঠিত করতে পারে নি, বাস্তবিক অর্থে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যে রাষ্ট্রযন্ত্র প্রলেতারিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে ফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াজীর সকল যুদ্ধংদেহী সংগঠনকে (স্টর্ম ট্রুপ, স্টিল হেলমেট ও রাইখসওয়েহ্র) আত্মীকরণ করেছিল। বুর্জোয়ারা কোনোরকম শক্ত প্রতিরোধ ছাড়াই জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের হাতে দেশের সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সক্ষম হয়েছিল, যারা শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি, ভয়াবহ সন্ত্রাস এবং রাজনৈতিক দস্যুতার মাধ্যমে কার্যসম্পাদন করছিল।
প্রলেতারিয়েতের বিজয়ী অভ্যুত্থানের শর্তগুলোকে বিশ্লেষণ করে লেনিন বলেছিলেন যে, পূর্ণাঙ্গ পরিপক্বতার পরই একটি নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে,
১) আমাদের বিরুদ্ধে যে সমস্থ শ্রেণীশক্তি আছে সেগুলো যথেষ্টভাবে নিজেদের মধ্যে জট পাকিয়ে ফেলেছে, পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ করে ফেলেছে এবং নিজেদেরকে যথেষ্ট ভাবে দুর্বল করে দিয়েছে এমন এক সংগ্রামের ক্ষেত্রে, যার মোকাবেলা করা তাদের সামর্থ্যের বাইরে,
২) বুর্জোয়াজীর থেকে স্বতন্ত্র পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের মতো সকল দোদুল্যমান এবং অদৃঢ় মধ্যবর্তী লোকজনেরা নিজেদের চেহারা জনগণের কাছে যথেষ্ট অনাবৃত করেছে, বাস্তব কর্মক্ষেত্রে দেউলিয়াপনার মাধ্যমে নিজেদের যথেষ্ট মর্যাদাহানী ঘটিয়েছে, এবং
৩) সর্বহারাদের মধ্যে বুর্জোয়াজীর বিরুদ্ধে কঠিন সংকল্পবদ্ধ, সাহসী ও একনিষ্ঠ বিপ্লবী সংগ্রামের সপক্ষে জনগণের একটা সেন্টিমেন্টদ্রুত বিকাশ লাভ করছে। তখন সত্যি সত্যিই বিপ্লব একটা পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়, সত্যি সত্যিই তখন যদি আমরা উপরে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত শর্তগুলো সঠিক ভাবে পরিমাপ করে থাকি এবং যদি আমরা সঠিক মুহূর্তটিকে নির্ধারণ করতে পারি তাহলে বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।
হিটলারের ক্যু-এর সময়ে যে পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হলো, বিজয়ী উত্থানের জন্য এর শর্তসমূহ সেই মুহূর্তে পরিপক্ব হয়ে উঠতে পারে নি। তারা তখন ছিল কেবল গর্ভাবস্থায়।
প্রলেতারিয়েতের অগ্রবাহিনী হিসেবে কম্যুনিস্ট পার্টি প্রসঙ্গে বলতে গেলে, তারা অহেতুক দুঃসাহসিকতা প্রদর্শনের ফাঁদে পতিত হতে অনীহ ছিল, তারা অবশ্যই নিজেদের তৎপরতার দ্বারা এই অনুপস্থিত শর্তের শূন্যস্থান পূর্ণ করতে পারত না।”
শিবদাস ঘোষ চীন বিপ্লব সংক্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টি এবং কমিন্টার্নের গৃহীত লাইনের বিরুদ্ধে ভ্রান্তির অভিযোগ উত্থাপন করেন (২৪ জুলাই, ১৯৫৬ সালে তাদের পত্রিকা ’গণদাবী‘তে প্রকাশিত – নির্বাচিত রচনাবলী প্রথম খণ্ড)। সঠিক ইতিহাস থেকে কিছু উদাহরণ দিয়ে আমরা ব্যাখ্যা করবো তাঁর এই ধরনের মতামত ত্রতস্কির মতানুসারী। চীন বিপ্লব প্রশ্নে ১৯২০ এর দশকের শেষার্ধ থেকে ত্রতস্কি, জিনভিয়েভ, রাদেক, এবং কামেনেভ সম্মিলিতভাবে ‘Stalinist bureaucracy’ এর নামে সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টি এবং কমিন্টার্নের গৃহীত লাইনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। এবং তারা অভিযোগ করেন কমরেড স্তালিনের নির্দেশনায় গৃহীত সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টি এবং কমিন্টার্নের লাইন চীন বিপ্লবকে ধ্বংস করে দিয়ে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। ত্রতস্কির অতীত ও বর্তমানের অনুসারীরা, ক্রুশ্চেভাইট সংশোধনবাদীরা, এবং সেইসাথে দ্বিধাপূর্ণ তথাকথিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদিরা এখন পর্যন্ত এই নোংরা অভিযোগ ও ব্যাপক প্রচার দিয়ে থাকেন। কমিন্টার্ন তাঁর গৃহীত লাইনের ব্যাখ্যায় বলছেন যে চীন বিপ্লবের প্রধানতম চরিত্রের দিকটি হচ্ছে সামন্তবাদ বিরোধিতা তথা কৃষি-বিপ্লবের নিষ্পত্তিকারী ভূমিকা- কারণ তখনও পর্যন্ত চীনের গ্রামাঞ্চলগুলোতে সামন্ততন্ত্রই ছিল সর্বাধিক প্রভাবশালী। সেইসময়ে চীনের মোট জনসংখ্যা ছিল ৪০ থেকে ৪৫ কোটির মধ্যে এবং এই জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯০ ভাগ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করতেন, এবং সামন্তবাদের ব্যাপক শোষণ ও নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন। মুলতঃ এই কারণেই কমিন্টার্ন তুলে ধরেছিল সামন্তবাদ বিরোধিতা তথা কৃষি-বিপ্লবের প্রধান নিষ্পত্তিকারীর ভূমিকা, অর্থাৎ চীনের বুর্জুয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের যোগসূত্র ও কৃষি-বিপ্লবের প্রধান নিষ্পত্তিকারীর ভূমিকা।
২৪ মে ১৯২৭ তারিখে এক বক্তৃতায় চীন বিপ্লবের প্রশ্নে ত্রতস্কি ও অন্যান্য বিরোধীদের মতামত কমিন্টার্নের গৃহীত লাইনের সঙ্গে তুলনা করে কমরেড স্তালিন বলেন,
“কমিন্টার্নের লাইনঃ যা চীনে প্রধানতম শোষণের মাধ্যম হিসেবে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের কথা বিবেচনা করে, কৃষি-বিপ্লবের নিষ্পত্তিকারী ভূমিকা, সাম্রাজ্যবাদের সাথে সামন্ততন্ত্রের যোগসূত্র এবং চীন বিপ্লবের বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক চরিত্র যা সাম্রাজ্যবাদের দিকে তার সংগ্রামের বর্ষামুখ স্থাপন করে তাকে বিবেচনায় নেয়।
ট্রটস্কির লাইনঃ যা সামন্তবাদী-যুদ্ধংদেহীদের নিপীড়নের প্রধান গুরুত্ব অস্বীকার করে, চীনে ব্যাপক ভিত্তিক কৃষি-বিপ্লবের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং চীন বিপ্লবের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্রকে শুধু মাত্র চীনা পুঁজিবাদের স্বার্থের সমার্থক মনে করে, যা কিনা (চীনা পুঁজিবাদ) চীনের জন্য শুল্ক-বিষয়ক স্বাধীনতা দাবি করছে।
ট্রটস্কির (এবং অন্য বিরোধীদের) মৌলিক ত্রুটি হল যে তিনি চীনে কৃষি-বিপ্লবকে অবমূল্যায়ন করেন, ঐ বিপ্লবের বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক চরিত্র অনুধাবন করতে পারেন না, চীনে যে শক্তিশালী কৃষি আন্দোলনের পূর্বশর্ত বিদ্যমান যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে টেনে আনছে, সেই আন্দোলনের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেন, এবং চীনা বিপ্লবে কৃষকের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করেন। এটা ট্রটস্কির ব্যাখ্যার উদ্ভটত্ব যে তিনি বুর্জোয়া দেখেন এবং প্রলেতারিয়েতকে দেখেন, কিন্তু কৃষককে লক্ষ্য করেন না এবং বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষকের ভূমিকা বোঝেন না – এই উদ্ভটত্বই চীনা প্রশ্নে বিরোধীদের মৌলিক ত্রুটির দিকটিকে গঠন করেছে। এটাই চীনা বিপ্লবের চরিত্রের প্রশ্নে ট্রটস্কি ও অন্যান্য বিরোধীদের অর্ধ-মেনশেভিকবাদকে গঠন করেছে। এই মৌলিক ত্রুটি থেকেই বিরোধীদের অন্যান্য ত্রুটিগুলো জন্মলাভ করেছে, চীনা প্রশ্নে এর থিসিসগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।”
(Stalin: Revolution in China and the Tasks of the Comintern, speech delivered at the 10th sitting of the 8th plenum of the ECCI, 24 May 1927)।
শিবদাস ঘোষ ত্রতস্কির অতীত ও বর্তমানের অনুসারী, ক্রুশ্চেভাইট সংশোধনবাদী, এবং সেই সাথে দ্বিধাপূর্ণ তথাকথিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদিদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ১৯৫৬ সালে বলেছেন চীন বিপ্লব সংক্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টি এবং কমিন্টার্নের গৃহীত লাইন ভ্রান্ত। ‘মার্কসবাদী’ শিবদাস ঘোষ ও ত্রতস্কিপন্থীদের অপপ্রচারের তথা ‘কমিন্টার্নের গৃহীত লাইন ভ্রান্ত’ এই তত্ত্ব আবিষ্কারের জবাব হতে পারে মাও সেতুং এর লেখা থেকে যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩ অগাস্ট ১৯৪৫ সালে,
“These are days of tremendous change in the situation in the far east. The surreder of the Japanese imperialism is now a foregone conclusion. The decisive factor for Japanese surrender is the entry of the Soviet Union into the war. A million Red Army troops are entering China’s North-Easst, this force is irreristable. Japanese imperialism can no longer continue the fight…. The Soviet Union has sent its troops, the Red Army has come to help the Chinese people drive out the aggressor, such an event has never happened before in Chinese history. “
তৃতীয় কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের জার্মানি এবং চীন সংক্রান্ত উপরোক্ত ব্যাখ্যা ও মুল্যায়ন ‘মার্কসবাদী’ নামধারী শিবদাস ঘোষ এর শিশুসুলভ আবোল তাবোল ব্যাখ্যা এবং ‘গভীর’ মার্কসবাদী চেতনার আসল রাজনৈতিক চরিত্র তুলে ধরে। এরই মধ্য দিয়ে দুই বাসদের অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক চরিত্র ফুটে উঠে। ফলে আজকে বাংলাদেশে এইসব সংশোধনবাদী ভাঁওতাবাজ ও ত্রতস্কিপন্থীরা মিলেমিশে একাকার হয়ে, যারা শ্রেণী চরিত্রের দিক দিয়ে পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর অন্তর্গত – আজকে গঠন করেছেন অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি, এবং এই পেটি বুর্জোয়াশ্রেণী সম্পর্কে কার্ল মার্কসের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখা শেষ করবো,
“সমাজে পেটি বুর্জোয়ারা তাদের অবস্থানের কারণেই আবশ্যিকভাবে একদিকে সোশ্যালিস্ট, অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ হয়ে উঠে, অর্থাৎ বৃহৎ বুর্জোয়ার মহিমায় তাদের চোখে ধাঁ ধাঁ লাগে এবং জনসাধারণের দূর্গতির প্রতি তাদের সহানুভূতিও থাকে। তারা হচ্ছে একাধারে বুর্জোয়া ও জনসাধারণের লোক। অন্তরে-অন্তরে তারা এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, তারা নিরপেক্ষ এবং সঠিক ভারসাম্য খুঁজে পেয়েছে, যে ভারসাম্যটা সুবর্ণ মধ্যপন্থা থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র বলে তাদের ধারণা। এই ধরনের পেটি বুর্জোয়া অন্তর্বিরোধের গুণগান করে, কারণ অন্তর্বিরোধই তার সার নির্যাস। নিজে সে একটা রূপায়িত সামাজিক অন্তর্বিরোধ ছাড়া কিছুই নয়। কাজের ক্ষেত্রে সে নিজে যা, সেটাকে তার সমর্থন করতে হবে তত্ত্ব দিয়ে”।
============================
আর,কে ব্যানার্জি, বাংলাদেশ লেখক শিবির।
৭ নভেম্বর ২০১৭