৩১৮ বার পঠিত
৩১৮ বার পঠিত
একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, মানুষ মোটামুটি একই গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারা জীবন বলে। একই কথা। একই অনুসঙ্গ। অধিকাংশই নিজের বীরত্বগাঁথা কিংবা এই আরেকটুর জন্যে হলো না- জাতীয় গল্পকাহিনী।
বাবার এক বন্ধু ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। প্রায় সন্ধ্যাতেই আড্ডার আসরে কাকার সেই একই কাহিনী:
“টাংগাইল থেকে নাগরপুর হয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি এগিয়ে আসছে। যাবে ভাদ্রা-দৌলতপুর-বড়বিলা-তেরশ্রী-ঘিওর বাজার হয়ে মানিকগঞ্জ। আমাদের যে সোর্স ছিল, নাম আক্কাস। আক্কাস একদিন খবর পাঠালো। আমরা তখন সাটুরিয়ার দরগ্রামে অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। শোনামাত্রই যার যার মতো রেডি হয়ে বসে পড়লাম দরগ্রামের পাশ দিয়ে যে খাল গেছে তার পাড়ে। রাত পেরিয়ে যায়। মিলিটারি আসার নাম গন্ধ নেই। ব্যাটা আক্কাস ভুল সংবাদ দিলো না তো? আমি বললাম আর একটু এগিয়ে দেখি। ঠিকই এগিয়ে গেলাম। কিন্তু তখন রাত পেরিয়ে দিন হয়ে গেছে। মিলিটারি ঘিওর বাজার পুড়িয়ে দিয়ে মানিকগঞ্জের দিকে চলে গেছে ততোক্ষণে। একটুর জন্য সন্মুখ সমরের অভিজ্ঞতাটুকু হলো না…”
কাকার গল্প চলতেই থাকে বছরের পর বছর। অথচ মিলিটারি যে পথ দিয়ে যাচ্ছিল দরগ্রাম থেকে তার দূরত্ব কম করে হলেও মাইল পাঁচেক তো হবেই। পাঁচ মাইল দূরে অবস্থান নিয়ে বসে থাকা মুক্তিযোদ্ধা কাকার এই ‘আরেকটু হ’লে‘ বীরত্বের গল্প সারা শৈশব-কৈশোর শুনে এসেছি।
আমাদের এলাকায় এক রাজাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। একাত্তরে শান্তি কমিটির থানা সভাপতি। ৭৫-এর পরে এলাকায় নানারকম অত্যাচার শুরু করলো। তারপর থেকে বাবার গল্প,
“এখন তো হাকিম ভাই বলেন, ‘এই তোর জন্যেই তো ব্যাটা এখনো বেঁচে। ১৬ ডিসেম্বর রাতে ক্যাম্পে ধরে আনলাম। চোখ বেধে ফেলেছি। পজিশন নিয়েছি। শুধু একটা চাপ। কিন্তু তুই ব্যাটাকে শেষ করতে দিলি না। বললি, থাক হাকিম ভাই, ছেড়ে দ্যান। এখন তো জ্বালাবেই।”
বাবার আক্ষেপ সারাজীবন,
“আহা, কেন যে রাজাকারটাকে বাঁচিয়ে রাখলাম। তখন আরেকটু চোখ বন্ধ রাখলেই তো শেষ হয়ে যেতো।“
মানুষ অসহায় হলেও বুঝি সারাজীবন এই ‘আরেকটু‘র আপসোস করে।
অথচ সময় বড় নির্মম। অধিকাংশ মানুষই অতীতের ‘আরেকটু‘র পুনরাবৃত্তি দেখতে পায় না। যা চলে যায়, তা চিরদিনের জন্যেই যায়। চলে যাওয়া সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া সে তো আরেক চোরাবালি। অধিকাংশ মানুষ সেটা বুঝতেই পারে না। বহতা সময়ের সারথি হয়ে এভাবেই বহে চলে মানুষের জীবন। কেউ শক্ত-সামর্থ হয়ে রশিটা তুলে নেন নিজের হাতে কিন্তু অনেকেই ছেড়ে দেন অদৃশ্য- অদৃষ্ট-নিয়তির হাতে।
(২)
আমার বড়মা (জেঠিমা) কালবোশেখী ঝড় এলে গলায় শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে খোলা উঠোনে কাঠের পিঁড়ি উল্টো করে পেতে বায়ুর দেবতা পবনের উদ্দেশ্যে বলতেন, “পবন দক্ষিণ দিকে যা”।
পাশ থেকে একজন বলতো, “আরে দিদি কী বলছো, দক্ষিণ দিকে তো তোমার বাপের বাড়ি”।
বড়মা সংশোধন করে বলতো, “পবন, দক্ষিণ দিকে যাস না, উত্তর দিকে যা”।
আবার পরক্ষণেই বুঝতো “উত্তর দিকে তো বোনের বাড়ি”।
আবার সংশোধন করে বলতো, “পবন, দক্ষিণ-উত্তরে যাস না, পূব দিকে যা”।
আরেকজন বলত, “পূব দিকে তো মিনুর বিয়ে হয়েছে, কী বলছো এসব”।
বড়মা সেটাও সংশোধন করে পশ্চিম দিকে কালবোশেখীকে যাওয়ার জন্য বলেই বুঝতো পশ্চিম দিক থেকেই ঝড় ধেয়ে আসছে। ফলে পশ্চিম দিকে আর যাওয়া সম্ভব নয়।
অসহায় বড়মা তখন নিয়তির উপর ছেড়ে দিয়ে বলতো, “পবন, তোর যে দিকে খুশি সেদিকেই যা, কিন্তু কারও ক্ষতি করিস না”।
একেকবার ভাবি, নিয়তি, অদৃশ্য ও অদৃষ্টে বিশ্বাস করেই তো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বেঁচে আছে। সে নিয়তি ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ-যিশু হবেন সেটা শুধু নয়। সমাজের প্রতিপত্তিশালী মানুষ কিংবা দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা কতো ক্ষমতাসীন রথি-মহারথিদের আশীর্বাদ ও অনুকম্পার ওপরে কোটি কোটি মানুষ বলির পাঁঠা হয়ে পড়ে আছে। এইসব ক্ষমতাদাম্ভিকগণ তো একপ্রকার নিয়তিই- আমাদের মতো অধিকাংশ সাধারণ মানুষের কাছে।
আমরা কিছুই করতে পারি না। কোনোদিকেই প্রলয়কে যেতে বলতে পারি না। কারণ, সবদিকেই তো মানুষ। বড়মার মতো করে শুধু বলতে পারি, “ তোদের যেদিকে খুশি যা, কিন্তু কারও ক্ষতি করিস না”।
(৩)
কিন্তু চাই বা না-চাই দেশে দেশে মানুষের প্রতি পাশবিকতা তো হচ্ছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান-সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে কী নির্মম নারকীয়তা হচ্ছে। সবই ধর্মের নামে। ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে, ধর্মে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে এবং কখনো কখনো একই ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে এ নারকীয়তা।
মহাত্মা গান্ধীর দেশ, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রাণপুরুষ নেহেরুর দেশ, অহিংসার প্রচারক মহামতি বুদ্ধের দেশ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত। নিছক ধর্মের নামে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটছে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতেও।
কেনো এসব হচ্ছে? এর পেছনে কা’দের ইন্ধন আছে? রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি- কোথায় এর শেকড়? এ নিয়ে হাজারটা যুক্তিতর্ক আছে। বছরের পর বছর এ নিয়ে আলোচনা করাও যাবে। কখনো পক্ষের- কখনো বিপক্ষের নিক্তি ভারী হবে। কিন্তু যেই-ই জিতুক, আসলে পরাজিত হবে মানুষ। দলিত হবে মানবতা। নিষ্পেষিত হবে মানবিক মুল্যবোধ।
আমাদের মতো আমজনতার কতোটুকুই বা করার আছে; শুধুমাত্র মানুষের শুভবুদ্ধি নামক নিয়তির হাতে সবকিছু ছেড়ে দেয়া ছাড়া! কিন্তু প্রতিবাদের ভাষাটুকু সচল রাখতে হবে- হোক না তা আপাতদৃষ্টিতে যতই ম্রিয়মান। কে জানে, অসংখ্য বিন্দুর সম্মিলনেই সিন্ধুর মতো উত্তাল হয়ে ভাসিয়ে নেবে অমানবিক দানবদের একদিন। জয় হবে মানুষেরই। জয় হবে মানবতারই।
টরেন্টো, কানাডা।
২৯ জুন,২০১৭
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন