৯৬৮ বার পঠিত
ছাত্ররা জাতির ভবিষৎ এটা চরম সত্য। তারা সামনে থেকে নেতৃত্ব থেকে দিবে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর বিপ্লবে। তরুণ বয়সে ছাত্ররা নানামুখী সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নিবেই। সব ঠিক হবে সেটা যেমন নয়, তেমনি সব ভুল হবে সেটাও ঠিক নয়। তরুণ তার তারুণ্যকে ধরে রাখে তার কর্মে তার বুদ্ধিদীপ্ততায়। বাংলাদেশের শুরুথেকেই মানে বাংলাদেশের জন্মলগ্নথেকেই তরুণরা সব আন্দোলন, দাবি আর অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছে; আর একাত্তর পরবর্তীতে দেশে যেসব সফল আন্দোলন হয়েছে সেগুলোর মশালও ছাত্রদের হাতেই ছিল। নব্বয়ের দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আর কয়েকমাস আগের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এমনকী কোটাবিরোধী আন্দোলনেও শিশু- কিশোর, ছাত্র, তরুণ আর যুবাদের অংশগ্রহণ ছিল দেখার মতো। সেই স্বৈরাচারের পতন থেকে সড়ক মেরামতসহ কোটার যে বৈষম্য তার সমস্যাগুলো সামনে নিয়ে আসছে সব তরুণেরা এককথায় ছাত্ররাই।
স্বৈরাচার পতনের সফলতা সাথে সাথে পাওয়া গেলেও সড়কের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে তবে ধীরে, আর কোটা ব্যাবস্থার ক্ষেত্রেও তাই, এতোদিন ধরে চলে আসা সমস্যা সামনে এসেছে এবং সমাধানের প্রক্রিয়া চলমান।
এ থেকে এটা প্রতীয়মান যে ৫২, ৬৯, ৭১ এরপরেও ছাত্ররা ছাত্রই আছে, তাঁদের ভিতর সেই স্পৃহা আছে এবং দাবি আদায় ও ভলো কাজের লক্ষ্যে এখনও রাজপথে নামতে পারে। বাংলাদেশের জন্মের পর রাজনৈতিক অনেক সিদ্ধান্ত যেমন সুদুরপ্রসারী ছিল তেমনই কিছু সিদ্ধান্ত ছাত্র ও ছাত্রসমাজ থেকে এসেছে যেগুলো অনেককিছু বিশ্লেষণ ও অনেক আলোচনার দাবি রাখে।
সমসাময়িক রাজনীতিতে সৎ, দক্ষ ও জনপ্রিয় নেতার উপস্থিতি খুব বেশি লক্ষণীয় নয়, সত্যিকার অর্থে সেই ধরনের নেতা তৈরি হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু, ফজলুল হক, কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীদের মতো তুখোড় ছাত্রনেতার দেখা খুব মিলছে না বা মেলেনি গত দশক বা তার আগে। হালের সোহেল তাজ, আন্দালিব পার্থ কিংবা জুনায়েদ সাকিরা রাজনীতিতে আসলেও নানা কারণে তাঁরা নিজেদেরকে মেলে ধরতে পারছেন না।
অবস্থা এমন দাড়িয়েছে আদর্শ ধারন করার বদলে ছাত্র-যুবরা অস্ত্রধারন করছে, লিডার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার আগে ক্যাডার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। ফলে, যে ছাত্র বা আগ্রহী যুবা রাজনীতি আগ্রহী ছিল বা যারা একটু সচেতনভাবে চিন্তা করতে পারে তারা দিনে দিনে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
ক্রমগত শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতি থেকে তৈরি হচ্ছে সন্ত্রাস, দখলদারিত্বসহ ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ ও এর প্রভাব চরমভাবে পড়ছে জনজীবনে। মানুষ এখন রাজনীতি বা পলিটিক্স এর নামে আতংকিত হয়, প্রকম্পিত হয়। যেকোনভাবে রাজনীতি দূরে থাকতে পারলেই যেন মুক্তি।
দেশে রয়েছে ৪০ টিরও অধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়, আছে ১৫০ এর অধিক অসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়। বিশ্ববিদ্যলয়গুলো জ্ঞান চর্চার তীর্থকেন্দ্র, সকল রাজনীতির সূচনা এখান থেকেই, চায়ের আড্ডাতে মুক্তচিন্তার আভাস মিলে, মতের প্রতি শ্রদ্ধা, দায়বোধ আর দেশ জাতির প্রতি নিজ দায়িত্ববোধ থেকে সমাজে তার প্রভাব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মূলত একজন ছাত্র এখান থেকেই পেয়ে থাকে। কিন্তু দেশে চলমান অবস্থা এতোই নাজুক যে দেশের বিশ্ববিদ্যলয়ের সম্মানিত উপাচার্যগণ নানা কেলেংকারী, আর নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে নানাভাবে জড়িত হয়ে পড়েছেন। সাথে বিশ্বজিৎ থেকে আবরার হত্যাকাণ্ড, হলি আর্টিজেন থেকে বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক হত্যা সবক্ষেত্রেই ছাত্রদের সম্পৃক্ততা কোন না কোনভাবে ছিল বা আছেই।
আর এই পরিস্থিতির মধ্যে বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ড দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বলা হচ্ছে সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন এর সাথে জড়িত এবং সেটা অনেকাংশে প্রমাণিতও হয়েছে, ফলত এই ঘটনা সরকারকেও কোন না কোনভাবে চাপে রেখেছে।
আর আবরার হত্যাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সবথেকে প্রসিদ্ধ এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আর এই সিদ্ধান্ত সামনে আসলে তিনটি প্রশ্ন, তুলে নিয়ে আসছে সাধারণ মানুষের মনে-
১) ভবিষৎ রাজনীতিতে কারা আসবে?
২) এখন থেকে কি ছাত্র রাজনীতির শেষের শুরু?
৩) অন্যকোন উপাই কি ছিল না?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে ভবিষতে যারা রাজনীতিতে আসবে তাদের ভিতর রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক জ্ঞানের স্বল্পতা থাকবে বা থাকতে পারে এটা যেমন অসম্ভব নয় আবার গঠনগত যে রাজনীতি তার একরকমই শেষই বলা চলে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যলয়গুলোর যে সংস্কৃতি, পুরোপুরিভাবে না হলেও সবাই তাদের থেকে ভালো কাউকে অনুসরণ করে। এখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যলয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ, তার অর্থই হচ্ছে এখন যেভাবে আন্দোলন আর ছাত্ররা রাস্তামুখী হচ্ছে তাতে করে যদি আবারো কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়ে ঘটে তবে সেই বিশ্ববিদ্যলয়েও ছাত্ররাজনীতি যে বন্ধ হবে না, এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। ফলত: ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ যে খুব ভালো নয় সেটা বলাই যায়।
তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় ছাত্র রজনীতি বন্ধ না করে আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলসহ অন্যান্য দলগুলোর উচিত ছিল ছাত্ররাজনীতিতে যে ক্যাডারশিপ সেটার লাগাম টেনে ধরা। শুদ্ধ রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটানো এবং শুদ্ধি অভিযান চালানোর মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
আর এই যে হত্যাকাণ্ড এগুলোর দায় যেমন মূল সংগঠন ও তার ছাত্র সংগঠন এড়িয়ে যেতে পারে না, তেমনি বিশ্ববিদ্যলয় প্রশাসনও এড়িয়ে যেতে পারে না।
সবমিলিয়ে কথা হলো যেহেতু ছাত্র রাজনীতি আর দেশের ভবিষ্যতের প্রশ্নের সাথে জড়িত, সেহেতু এর সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার প্রথমত সরকার ও তার দলীয় সংগঠনের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান এবং পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে ভিন্ন দল, মত, ব্যক্তি গোষ্ঠীর প্রতি শ্রদ্ধা। এরপর মুক্তিযুদ্ধের অপশক্তির বিপক্ষে আইনসিদ্ধধভাবে সকলের সহযোগিতায় লড়া।
আর অন্যান্য যেসব দল আছে, তাদেরও উচিত নতুন পরিকল্পনা ও রাজনৈতিকভাবে আর পরিপক্ক নেতা তৈরিতে মনোনিবেশ করা, নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করার সাথে সরকারের এই কাজে সহযোগিতা এবং নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়া।
আর তা না হলে যদি এই ভয়াবহ অবস্থা চলতে থাকে তাহলে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যখন আমরা আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস ভুলে যাবো, আমাদের ঐতিহ্য ভুলে যাবো; ভুলে যাবো আমাদের রাজনৈতিক সত্তাকে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন