দার্শনিক পাইথাগোরাস বলেছিলেন, ‘থিংস আর নাম্বারস’, অর্থাৎ বস্তুবিশ্ব সংখ্যা দিয়ে গঠিত বা বস্তুজগতকে আমরা সংখ্যার মাধ্যমে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারি, বুঝতে পারি। সংখ্যা বস্তুজগতের ভিত্তি নাও হতে পারে কিন্তু এটা আমাদের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা, সংখ্যা দিয়ে আমরা জগত-সংসারের ‘দশ হাজার বিষয়‘কে আমাদের মাথায় বিন্যস্ত করি, সাজাই। আধুনিক সমাজেও মানুষকে এখন বিভিন্ন সংখ্যার দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যেমন, ভোটার নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্র, সামাজিক নিরাপত্তা নাম্বার, করদাতার নাম্বার, ড্রাইভিং লাইসেন্স নাম্বার। কারো নাম বা পরিচয়ের চাইতে এসব নাম্বার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে প্রাচীনকালের মত বিমূর্ত সংখ্যার ধারণা আজো কার্যকর। বর্তমান ডিজিটাল প্রযুক্তির কালে এর প্রভাব আরো বেশি, দুনিয়ার সবকিছুকেই এখন মাত্র দুটি সংখ্যা (১,০) দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব।
মানুষের সংখ্যার ধারনায় সংখ্যাতত্ত্ব বা নিউমারোলজি নেই তা অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু সেটাই মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয় না, জ্ঞানের বিভিন্ন ধারনার বিকাশ বুঝতে সংখ্যার সাহায্য নেয়া হয়েছে মাত্র। সংখ্যার ধারনা দিয়ে বিভিন্ন বিষয় বর্ণনার এ রীতি অনেক পুরনো। এখনো গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে,
“এক আল্লাহ, দোজাহান, তিন জমানা, চার কিতাব, পাঁচ কালেমা, ছয় হাদিস, সাত বেহেশত, আট দোযখ “
ইত্যাদি গণনা পদ্ধতি। প্রত্যন্ত বাংলার বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসাতে আজও এই গণনা পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।
প্রতিটি সংখ্যার সাথে জড়িত ধারণাগুলোর আলোচনায় দেখা যায় এর ধর্মীয় এবং পৌরাণিক প্রভাব যেমন আছে তেমনি রয়েছে দর্শন, সাহিত্যে তার উপস্থিতি এবং প্রভাব। বিজ্ঞানের জগতেও ওইসব সংখ্যার ধারনা এবং সংশ্লিষ্ট ধারনাগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
ধর্ম এবং দর্শন মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নানান ধর্মীয়ধারা এবং পুরাণে মানুষের ধর্মীয় চেতনার বিকাশ হয়েছে। ধর্মীয় আচরণবিধি এবং পুরাণ আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছে। পুরাণের শক্তি নিয়ে বিখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক জোসেফ ক্যাম্পবেল দেখিয়েছেন মানুষের জীবনের একটা বিশাল অংশ পুরাণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পুরাণ ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। কোন সমাজে পুরাণের চর্চা না থাকলে দেখা যায় নতুন প্রজন্ম তাদের বেড়ে ওঠার সাথে নিজেদের পুরাণ গড়ে নেয়। ব্যস্ত শহরের বস্তিতে পুরাণের প্রভাব নাই এমন অঞ্চলে দেখা গেছে গ্যাং, কাল্ট ইত্যাদি তাদের নিজস্ব পুরাণ তৈরি করে নেয়। যেমন, আমেরিকার লস এঞ্জেলেসের মত বড়, ব্যস্ত এবং আধুনিক শহরে প্রায় পাঁচ শতাধিক গ্যাং এবং কাল্ট আছে। এসব গ্যাং এর নিজস্ব কালচার, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচরণবিধি আছে যা তারা কঠোরভাবে মেনে চলে। পুরাণ তাই মৃত বা অতীতের কিছু নয়, মানুষের জীবনে পুরাণের বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরাণ জীবন্ত হয়ে ওঠে। পুরাণের প্রাচীনত্বের কারণে দর্শন এবং বিজ্ঞান পুরাণের অনুসারী, এর উল্টোটা নয়।
পুরাণের মত সমাজে বিভিন্ন দর্শনের চর্চা হয়ে আসছে। এসব দর্শন অনুসরণ করে তাদের অনুসারীরা তাদের জীবনাচরণ নির্ধারণ করে।একটা দর্শনের সাথে তার উপযোগী পৌরাণিক কাহিনী ব্যবহার করে ধর্মের উৎপত্তি হয়। কোন সমাজে নির্দিষ্ট দর্শনের কোন প্রভাব দেখা না গেলে সেটা মৃত দর্শন, কিন্তু পুরাণের মরণ হয় না। পুরাণ সবসময় জীবিত, কখনও হারায় না। একটা সমাজে কোন নির্দিষ্ট সময়ে পুরাণের প্রভাব দেখা না গেলেও যেকোন সময়ে সেটা ফেরত আসতে পারে।
বেদ, মহাভারত, রামায়ন, বাইবেল এর মত ধর্ম বইয়ের সাহিত্যিক মূল্য আছে। বস্তুতঃ মানুষের ধর্মীয় জীবন কাটে এক ধরনের সাহিত্য সমালোচনায়। ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর নানান ব্যাখ্যা, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কত দল-উপদলের সৃষ্টি হয়ে মানুষ আজ বিভক্ত। এসব পুস্তকের নানা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মানুষ একে অপরকে বিচার করে, তারা একে অপরকে বিভিন্ন মাজহাব বা মতবাদ ও পন্থার অনুসারী মনে করে। যার থেকে অনেক হানাহানি এবং বিবাদ-বিসংবাদের উৎপত্তি। সেভাবে বিচার করলে আমরা প্রত্যেকে একেকজন কট্টর সাহিত্য সমালোচক। প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় সাহিত্যের একটা বিশাল অংশ ধর্ম এবং পুরাণ নিয়ে। মানুষের গল্প বলা,শোনা এবং অন্যের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার একটা প্রবণতা আছে। তাই সে গল্প বলতে এবং শুনতে ভালবাসে। ভারতের কথক নাচ, আসলে গল্প বলার নাচ। তেমনি আদিম সব সমাজেই পৌরাণিক গল্প চালু আছে, যার দ্বারা তারা জগতের সাথে সম্পর্কিত হতো। কিন্তু আধুনিক সমাজে এসে মানুষ সমাজে জনবিচ্ছিনভাবে বাস করার ফলে আমাদের জীবনে পৌরাণিক প্রভাব কমে এসেছে।
সাহিত্যে পুরাণ এবং ধর্মের প্রভাব থাকায় সাহিত্যেও সংখ্যার প্রতিফলনে বিভিন্ন ধারনার উপাদান দেখা যায়। আধুনিক মানুষের জীবনে সাহিত্য এবং ধর্মের প্রভাব মোটামুটি একই ধরনের, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে শিল্প বিপ্লবোত্তর ইওরোপে সাহিত্যকে ধর্মের আসনে বসানোর চেষ্টা করা হয়।
ইওরোপিয় নবজাগরণ এবং বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারের ফলে সমাজে ব্যক্তির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। শিল্প-কাজে নিয়োজিত লোকেদের নিয়ে আধুনিক শহুরে সমাজে একটা ছিন্নমূল, বেতনভূক শ্রমিক শ্রেণী তৈরি হয়। তাদের গ্রামীণ সামাজিক জীবনের অতীত ঐতিহ্য এবং সামাজিক অবস্থার অবসান ঘটায় এ শ্রেণির মধ্যে ধর্মের প্রভাবও কমে আসে। এ নতুন শ্রেণীর লোকগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তখন ধর্মের বিকল্প হিসেবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বুর্জোয়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিল্প-সাহিত্য রচনা করা হয়, এবং সাহিত্য মোটামুটিভাবে পুরাণ ও ধর্মের স্থান নেয়। একইসাথে নাগরিক নতুন মধ্যবিত্তকে আত্মা দিতে ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি ভাষার শিক্ষা চালু করা হয়। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে এর প্রমাণ দেখা যায়। অক্সফোর্ডের প্রথমদিককার ইংরেজির অধ্যাপক জর্জ গর্ডনের ভাষায়,
“England is sick, and . . . English literature must save it. The Churches (as I understand) having failed, and social remedies being slow, English literature has now a triple function: still, I suppose, to delight and instruct us, but also, and above all, to save our souls and heal the State.”
আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ তাই বিজ্ঞান না জেনে আমাদের উপায় নেই। বর্তমান ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে সংখ্যার সাথে সম্পর্কিত এমন বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো সম্বন্ধেও আমাদের জানা দরকার।
ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান জ্ঞানের এ তিনটি শাখাতেই সংখ্যার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের মৌলিক ধারনাগুলোর সাথে সংখ্যাতাত্ত্বিক চিন্তার সম্পর্ক খুবই গভীর। সংখ্যা বা গণনা ছাড়া আমরা চিন্তা করতে পারি না। প্রক্রিতির ভাষা গণিত মানে সংখ্যা এবং গণনা পদ্ধতি, তাই প্রকৃতিকে বুঝতে মানবমনের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি যেভাবে চিন্তা করেছে তাতে সংখ্যার একটা গুরুত্ব রয়েই গেছে। নিজের অস্তিত্বের কারণে মানুষ এক সংখ্যাটিকে যেভাবে বোঝে, তার থেকে সে ‘বহু‘কে বুঝতে পারে। আদিম অনেক সমাজে দেখা গেছে তারা কেবলমাত্র দুটি সংখ্যা ‘এক‘ এবং ‘বহু‘ দিয়েই হাজার হাজার বছর কাজ চালিয়ে এসেছে। আধুনিক দর্শন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় প্রথায় ‘এক আর বহুর দ্বন্দ্ব‘ ( One and Many problem) আজও একটি অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। সচেতন প্রাণী হিসেবে আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের দ্বন্দ্বময় অবস্থান এর জন্য দায়ী, তাই এর কোনটাকেই অস্বীকার করা যায় না বা ভুল বলা যাবে না। আমাদের নিজেদের একক অস্তিত্ব যেমন সত্য, তেমনি সত্য বিশ্বজগতের আরো কোটি কোটি জিনিসের অস্তিত্ব।
একইভাবে শুন্যের অস্তিত্ব কল্পনা এবং গণনা পদ্ধতিতে শুন্যের ব্যবহার মানুষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। শুন্যের ধর্মীয় এবং দার্শনিক প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না।
আমাদের শরীরে ডান-বাম প্রতিসাম্যতা আছে, যার কারণে আমরা একত্বের মধ্যেও দুইয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। ডান-বাম, উপর-নীচ, পূর্ব-পশ্চিম আমাদের মনের কল্পনামাত্র, বস্তুজগতকে বুঝার চেষ্টায় আমাদের তুলনা করার সুবিধার্থে আমরা এসব কল্পনা করি। আমাদের চিন্তা-চেতনায় দুইয়ের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, দুই (২) না হলে আমরা এককে অপরের সাথে তুলনা করতে পারি না, ফলে আমাদের কোন বোধগম্য জ্ঞান বা আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ পৌছানো সম্ভব হয় না।
দুই’য়ের মধ্যে তুলনা যেমন বোধগম্যতা, সম্পর্ক সৃষ্টি এবং জ্ঞানের আলোচনার জন্য জরুরী তেমনি তিনের (৩) ধারনা আমাদের জ্ঞান-কাঠামোর একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়। দুনিয়ার প্রায় সব ধর্মে ‘পবিত্র ট্রিনিটি‘র ধারনা থেকে মানুষের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় চিন্তায় তিন সংখ্যার গুরুত্ব বুঝা যায়। গণিতে বিশেষ করে জ্যামিতিক আকার, আকৃতিতে সর্বকণিষ্ঠ কাঠামো হলো ত্রিভুজ, যা আসলে তিনটি বিন্দুর মধ্যে সমন্বয়। এ ত্রিভুজের ধারনা এবং কোণ দিয়ে আমরা দুনিয়ার যেকোন কাঠামোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারি।
একইভাবে ৪, ৫, ইত্যাদি ছোট ছোট সংখ্যা থেকে শুরু করে অনেক বড় সংখ্যা যেমন আলোর গতি (৩০০০০০ কিলোমিটার/সেকেন্ড), বা পদার্থের অভ্যন্তরীণ অণু বা পরমাণুর সংখ্যা বুঝাতে যে এভেগেড্রো সংখ্যার (৬.০২৩ X ১০^২৩) ব্যবহার আমাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে আসছে। এসব সংখ্যা ছাড়াও কিছু বিশেষ সংখ্যা যেমন, পাই (৩.১৪১৫৯), গোল্ডেন র্যাশিও (১.৬১৮০৩) , এবং সংখ্যার বিভিন্ন সিরিজ আমাদের চারপাশের জগতকে বুঝতে সহায়তা করছে। মানুষের চিন্তার জগতকে বুঝতে, তথা বিশ্বপ্রকৃতিকে বুঝতে আমাদের সংখ্যা এবং সংখ্যার নানা তত্ত্বের সাহায্য নেয়া ছাড়া কোন গতি নেই। দার্শনিক পাইথাগোরাসের মতকে তাই উড়িয়ে দেয়া যায় না, ‘থিংস আর রিয়েলি নাম্বারস‘।
চলবে……
২য় পর্ব পড়ুন এখানে: