৪৬১ বার পঠিত
কবি সামসুর রাহমানের দ্বিতীয় কবিতার বইটি পড়ি আশির দশকে ; বইয়ের নাম “ রৌদ্র করোটিতে”। কাব্যগ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশ হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। আমি যখন বইটি ঢাকা নিউমার্কেট থেকে কিনি তখন ৩য় সংস্করণ বেরিয়েছে। ছিঁড়ে যাওয়া মলাটের উল্টোপিঠে কেনার তারিখটি লিখা নেই কিন্তু যে বন্ধুটি বইটি কেনার সময় সাথে ছিল তার হাতের লেখায় তখনকার স্থায়ী ঠিকানাটি আছে; ৯, পশ্চিম ছাত্রাবাস, ঢাকা কলেজ,ঢাকা। মলাট থেকে বইয়ের পাতাগুলো একরকম বিচ্ছিন্ন হয়েই গেছে; কিন্তু বইটি কেনার মুহুর্ত ও বইটি পড়ার পরের আবেশটুকু এখনো তাজা গোলাপের মতো টুক্টুকে রঙীন।
একটি কবিতার বই তখন আমাকে অন্যরকম এক ভাবনার দ্যোতনায় এভাবে নাড়া দেবে তা আমার বোধের অতীত ছিল সে সময়- একথা স্বীকার করতে এতটুকুও কুন্ঠিত নই। এর আগে অনেক বই আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে, রাঙিয়ে দিয়েছে, বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিয়েছে, রাত জাগিয়েছে, মাঠেঘাটে আলোতে অন্ধকারে হাঁটিয়েছে, খা খা কড়া রোদে পুড়িয়েছে,দিনের পর দিন পেট ব্যথার অজুহাতে ইস্কুল কামাই করিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে একা ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু সে সবের অধিকাংশই বিখ্যাত বিখ্যাত লেখক-কবিদের উপন্যাস, প্রবন্ধ কিংবা কাব্য- যার অধিকাংশ জুড়েই ছিল ইতিহাস-সংস্কৃতি-অতীত ঐতিহ্য –স্বদেশ প্রেম- চিরচেনা প্রকৃতি কিংবা বয়ঃসন্ধিক্ষণের নিটোল প্রেম।
একটি বইয়ের কথা না বললেই নয়, মোতাহার হোসেন চৌধুরীর “ সংস্কৃতি কথা”। একজন ইস্কুল ছাত্রের বইটি ভাল লাগার তেমন কারণ ছিল না তখন, অথচ ভাললাগার মতো সাগ্রহে পড়েছিলাম বইটি। রবীন্দ্রনাথের “শেষের কবিতা” বয়ঃসন্ধিক্ষণের সে বুকধরপর সময়ে ভাল লেগেছিল খুব। ইন্দ্রনাথ হয়ে গিয়েছিলাম শরৎচন্দ্র পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে এ রকম ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রকৃতির বর্ণনা- এখনও চিত্তে দাগ এঁকে আছে চিরস্থায়ী ভাবে। মায়ের খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম-বিশেষত ব্যক্তি নজরুলের সংগ্রাম ও দুঃখময় জীবন। কাজী নজরুল ইসলামের প্রাণের সতীর্থ কমরেড মোজাফফর আহমদের লেখায় নজরুল জীবনী পড়ে বুকের কোথায় যেন একটি হাহাকার বাসা বেঁধেছিল এ ক্ষণজন্মা মানুষটির প্রতি।
এ রকম অসংখ্য বই ইস্কুলের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসে পড়া ফাঁকি দিয়ে পড়েছিলাম তখন। এক একটি বই পড়া মানে একটি নতুন ভুবনডাঙায় বেড়ানো। তখন এ্যভিনিউ শব্দটির মতো নাগরিক সব শব্দাবলীর সাথে পরিচিত হইনি। তাই একটি প্রান্তর থেকে অন্য একটি প্রান্তরে ছুটিয়ে নিয়ে যেত একটি নতুন বই। কিশোর বয়সে যা হয়- ছাপার অক্ষর মানেই তো বাছবিচারহীন বিশ্বাস; আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু ছিল না তার। বই পড়ার নেশা আফিমের চেয়েও ভয়ঙ্কর; শিখেছিলাম এবং নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধিও করেছিলাম সে সময়ে।
“স্বপ্নচারী” শব্দটি খুব মানান সই হ’তো তখন। যদিও শব্দটি এখন যতটা আধুনিকতায় ব্যবহার করা হয়, আমাদের ইস্কুল জীবনে পড়াশুনার চৌহদ্দিতে “স্বপ্নচারী” শব্দটির ব্যবহার তেমন ভাবে পাইনি তখন। যতটা পেয়েছি “আদর্শ” “শুদ্ধ” স্বদেশিকতা” কিংবা “নৈতিকতা” র মতো শব্দগুলো। এখন মনে হয় “স্বপ্নচারী” কিংবা “স্বপ্ন” এ শব্দগুলোর সাথে “আদর্শ” “শুদ্ধ” স্বদেশিকতা” কিংবা “নৈতিকতা”-র মতো শব্দের চেয়ে “স্বার্থ” “স্বার্থকতা” “উন্নতি” কিংবা “সফলতা”-র মতো শব্দের যোগ বেশী। যা হোক, আমি কোন নীতিশাস্ত্র লিখতে বসিনি, তাই এগুলো অনুল্লেখ্য থাকাই যথোপযুক্ত।
আশির দশকে এসে তাই কবি সামুসুর রাহমানের ““ রৌদ্র করোটিতে” কাব্যগ্রন্থটি বিশাল এক ধাক্কা দিয়ে কূপোকাত করে দিল আমাকে। কাব্যগ্রন্থটিতে সংযোজিত ৮৬টি কবিতা আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল এক অনভ্যস্থ অচেনা নাগরিক জীবনে; এক একটি বর্ণিল এ্যভিনিউ থেকে আমি হেঁটে যেতে থাকলাম আর একটি বর্ণিল এ্যভিনিউতে।
“ জীবনকে তুখোড় ইয়ার ভেবে যদি সারাক্ষণ
মাতলামো করি আর শরীর গাঁজার গন্ধে ভ’রে
হুট করে চলে যাই সাঙ্গাতের ফুর্তিবাজ রকে…
…………………………………………।।
তবে কি বেল্লিক ভেবে সরাসরি দেবে নির্বাসন
চিরতরে অথবা লেখাবে দাসখৎ শোকাবহ
আত্মার সাক্ষাতে? যাই করো, চিরদিন আমি তবু
থাকবো অনড় সাক্ষী তোমাদের কাপুরুষতার।“
নিজেকে অস্থির করে তুললো প্রতিটি পংক্তি। দুঃখবোধ-জীবনযাপন-প্রেম-রবীন্দ্রনাথ-লালনের গান-ইতিহাস-স্বদেশ সবকিছু সবে কৈশোরউত্তীর্ণ এক যুবকের কাছে যেন ধরা দিল অন্যভাবে। কোন কিছুই নতুন নয়- কোন কিছুই নয় অশ্রুত। অথচ উপস্থাপনার আংগিক ভিন্নতর। উপলব্ধির ভাঁজে ভাঁজে যেন এক নতুন মোড়ক। চিরচেনা সব কিছুই অন্যভাবে বলা, অন্য দৃষ্টিভংগীতে অন্য কোণ থেকে আলোর প্রক্ষেপন। অনেক দিনের না-বাস করা ঘরে উজ্জ্বলতম নিওন বাতির আলো যেন। অনেক শোনা গান আরেকবার নতুন করে শোনার মতো।
“ যখন তোমার বাহুর বাসরে
মগ্ন ছিলাম চন্দ্রিত তন্দ্রায়,
আলো-আঁধারির চকিত সীমায়,
লালনের গান দূর হতে এলো ভেসে”।
ঠিক তেমনি; অবচেতনার গহন ধারায় তারাময় মনে স্বপ্নের পলির মতো সামসুর রাহমান ঠিক তেমনি পুলক জাগালো প্রথম পাঠেই। এখনো প্রতিদিন “ দুঃখ তার লেখে নাম ” সামসুর রাহমানের কথা মতোই। এখনো প্রতিমুহুর্তেই-
“আমার হৄৎপিন্ডে শুনি দ্রিমিক দ্রিমিক দ্রাক্ দ্রাক্
দুঃখ শুধু বাজায় নিপুন তার ঢাক ।“
এখনো চিরায়ত-শাশ্বত-লোকায়ত-সভ্য-সভ্যতা-গ্রামীন-নাগরিকের মতো অসংখ্য শব্দরাজি চেনা অচেনার সংগতে বেজেই চলে দ্বন্দমুখর হয়ে প্রতিদিন। এ দ্বন্দ নিরন্তর- নিরবধি-নিঃসীম; সময় থেকে সময়ে আবর্তিত হয়েই চলে।
আজ মধ্য দুপুরের রোদে সে বৃন্তে যোগ হয়েছে বিশ্ব-বিশ্বায়ণ কিংবা প্রবাস-এর মতো আরও কিছু শব্দ। কিন্তু “রৌদ্র করোটিতে” পড়া সেই শব্দগুলোর আবেশ তেমনি আছে এতো বছর পরেও।
কবি সামসুর রাহমানের প্রয়াণ দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন