১০৭৭ বার পঠিত
বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একতরফা হয়েছিলো যে তা প্রায় সকলেরই জানা। আবার তার পূর্বের সকল ধারাবাহিক ঘটনাবলী, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সার্বিক রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সেই পরিস্থিতিতে সকল দল ও মতের কুটনৈতিক কৌশল স্বাভাবিকভাবেই অবস্থাকে যে নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য ছিলো সেসময়, তাও সকলের জানা ও বুঝার বিষয়! কিন্তু এই জায়গাতেই যতো সমস্যা, দ্বন্দ্ব, মতভেদ ইত্যাদি দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে করে রেখেছে ঘোলাটে! সহজ সরল বাস্তবভাবে একটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি।
পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল যে তা ঐতিহাসিক সত্য, তবে এটা এর আগে ‘মুসলিম’ ছিলো বলেই! পরবর্তীতে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এবং তারপরে ‘আওয়ামী লীগ’! ভারত ভাগের পর পাকিস্তানের ‘মুসলিম লীগ’ স্থাপিত হলো ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ পরিবর্তিত হয়ে! অর্থাৎ সবই মুসলিম! কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল তখন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়ের। সঙ্গত কারণেই তাই ‘মুসলিম’ বাদ দিয়ে সংগঠনটি নতুন নামকরণে হয়েছিল ‘আওয়ামী লীগ’। তাতে অধিকাংশ হিন্দুসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ সমন্বিত হতে পেরেছিল এখানে। ফলে লীগ আরো বৃহৎ হয়েছিলো। পাশাপাশি কিছু কিছু প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনষ্ক যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী, ব্রিটিশ বিরোধী অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষ এবং তাদের সহযোগী হয়ে শ্রমিক ও পেশাজীবি শ্রেণীর কিছু আগুয়ান মানুষ ঐক্যবদ্ধ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিসহ কয়েকটি বাম রাজনৈতিক সংগঠনে। তথাপি, আওয়ামীলীগ ছিল বৃহৎ দল। এর মধ্যে ‘বিএনপি’র কোনো অস্তিত্ব ছিল না!
সোজা কথায় হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান মিলে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ছিল। এই পটভূমিতে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের ঘটনা বৃহৎ আওয়ামী লীগকে প্রভাবিত করেছিল। প্রভাবিত হয়েছিলেন তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, হোসেন সোহরোয়ার্দী প্রমুখ সকলেই। সেই ধারাবাহিকতায় উনসত্তুরে, সত্তুরে, একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তেজদ্বীপ্ত নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ হয়ে পড়েছিলো বৃহত্তম সংগঠন, বিএনপি বলে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না! জিয়া, খালেদা জিয়া নামে কোনো নেতার চিহ্নও ছিল না! আওয়ামীলীগ এর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কাফেলায় যোগ দিল কমিউনিস্ট পার্টিসহ অধিকাংশ বামদলগুলোও। সেই ডামাডোলে অবস্থার প্রেক্ষিতেই এসে গেলো বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যা আকস্মিকভাবেই পরিণত হয়ে গেলো ‘মুক্তিযুদ্ধ’ তে! ৬ দফা হয়ে গিয়েছিলো স্বাধীনতা আন্দোলনের চালিকা শক্তি, মুজিব হয়ে গিয়েছিলেন কিংবদন্তি নায়ক, আওয়ামীলীগ হয়ে গিয়েছিল একক রাজনৈতিক শক্তি! এই তামাম ইতিহাস কেউ তার খেয়াল খুশিতে বানায় নি, এমনকী বঙ্গবন্ধুও নয়। এটা অনেকটা প্রাকৃতিকভাবেই যেন এসে গিয়েছিলো বাঙালির জন্য, বাংলার জন্য। এখানে অন্য কিছু, অন্য কেউ বিএনপি, জিয়া, খালেদা ইত্যাদি কিছুরই প্রয়োজন ছিল না!
সাম্প্রদায়িকতা থেকে অসাম্প্রদায়িকতায় উত্তরণ ঘটেছিল বাংলার রাজনীতি, তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ। আর এর কার্যকরণ সূত্রের মূল জুড়ে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আবার শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সংগঠনের মাধ্যমেই। জাতির পিতা হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সফলতার মধ্য দিয়ে। এসবই সহজ ইতিহাস, সরল ইতিহাস।
অথচ পচাত্তরের পট পরিবর্তনে সেই সর্ব বৃহৎ সংগঠনকে দুমড়ে মুচড়ে নাস্তানাবুদ করে দিয়ে তারই ধারাবাহিকতায় আবির্ভুত হলেন রাজনীতি বহির্ভূত জগতের এক মেজর জিয়া! বাংলাদেশের রাজনীতিতে শনিগ্রহের মতো প্রবেশ করে অবশেষে নিজেও অকালে জীবন দিলেন, রেখে গেলেন বিতর্কিত তার ‘বিএনপি’! মাঝখান থেকে বৃহৎ আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ল! সাদামাটাভাবে বলা যায়, যারা মুসলিম আওয়ামী লীগ পুষতো মনে মনে সেই তারাই সমন্বিত হতে লাগলো বিএনপি’তে। সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় মৌলবাদী এবং সেই ধারায় ভারতবিরোধী মনোভাবাপন্ন আওয়ামী লীগ সদস্যরাই সমন্বিত হলো বিএনিপি’তে।
আবার বাম ধারায় কিছু মানুষ যারা ভারতবিদ্বেষী তাদের থেকেও কিছু নেতাকর্মী যোগ দিলেন বিএনপি’তে! অন্যদিকে পাকিস্তান সমর্থক মুসলিমলীগ এবং মৌলিবাদী জামাত এর কিছু কিছু মানুষও যোগ দিলো মেজর জিয়ার দলে। এ’ভাবে বিএনপি আওয়ামী লীগ এর সমান্তরালে এগিয়ে গিয়ে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ’কে ছাড়িয়ে গেল সদস্য ও সমর্থন সংখ্যায়! নির্বাচনী কৌশলে তাই হেরে গেল শেখ মুজিবুরের দল, স্বাধীনতা সংগ্রামের, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দল আওয়ামী লীগ। মাত্র ৪ বছরেই বাংলার জনগণের অর্ধেকের বেশি মানুষ বদলে গেল! খুব দ্রুতই ভুলতে শুরু করলো অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে! ফলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারদের, জামাত শিবিরদের পূনর্বাসনে বিএনপি এগিয়ে গেল সদর্পে! গোলাম আজমদের পাকিস্তান থেকে আনিয়ে নাগরিকত্ব দেয়া হল, মন্ত্রিত্বে বসানো হল! মসজিদ মাদ্রাসায় ভর করে জঙ্গি ধর্মান্ধতা চাষ করার সকল ব্যবস্থা করে দেয়া হল! এসবই সম্ভব হল ধর্মপ্রাণ মুসলিম বাঙালিদের উগ্র ইসলামি চেতনার কারণেই! বাঙালি মুসলমানরা ভুলে গেল আসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক একটি বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যেই তারা লড়েছিলেন সাম্প্রদায়িক পুঁজিবাদী চেতনার ধর্মীয় মৌলিবাদী দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে! তারা ভুলে গেলো চীন, আমেরিকার দোসর পাকিস্তান কখনোই বাংলাদেশের মিত্র হতে পারে না! তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আপাত: পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হবার এক দূর্বার আকাঙ্খায় ছিল তখন বাঙালি মুসলিমরা! স্বাধীন হয়েই অগণিত বাঙালির যেন সম্বিৎ ফিরে এলো যে তারাতো আসলে মুসলিম, বাঙালি হবে কেন! তাদের ধর্মতো ইসলাম, অসাম্প্রদায়িক হবে কেন! তারাতো হবে বাংলাদেশি, বাঙালি কেনো! এই আত্মোপলব্ধি থেকেই যে বিএনপি’র আত্মপ্রকাশ তা নয় কেবল।
বাংলার সহজ সরল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের রাজনৈতিক মগজ ধোলাই তখন অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। মেজর জিয়া যখন বুঝতে পারলেন যে, ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে সেনা আইন থেকে সরে আসতে হবে। আর সেনা আইন বাতিল করতে হলে তাকে ‘গণতন্ত্র’(?) এর আশ্রয় নিতে হবে। সে জন্য দরকার একটি রাজনৈতিক দল, যেখানে জড়ো হবে আওয়ামী বিরোধী, শেখ মুজিব বিরোধী (ইতোমধ্যে যারা আওয়ামীলীগ এর মধ্য থেকে ধর্মান্ধতার প্রভাবে বিচ্যুত), উগ্র ধর্মবাদী এবং পূনর্বাসিত স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মুসলিম বাঙালিরা!
তাই হলো।
মুক্তিযুদ্ধের তাজা ফসল বাংলাদেশের সংবিধান হলো ধর্ষিত। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন ভুলুণ্ঠিত হলো। মেজর জিয়া হলেন তার সৃষ্ট দলের প্রধান! হলেন স্বাধীনতার একমাত্র ঘোষক! হলেন দেশের প্রেসিডেন্ট! দেশনায়ক! তার জীবনের পরিণতি যাই হোক, তার বানানো দলে ইতোমধ্যেই জনগণের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যা সমন্বিত হলো যে, তাতো উড়িয়ে দেয়া যায় না! সেখানে ( বিএনপি’তে) জাতীয় পার্টির স্বৈরাচারী ভুমিকার কারণে তাদের পতনের ফলে বেশ কিছু নেতাকর্মী এবং বহু সদস্যও প্রায় বিএনপি আদর্শের কাছাকাছি থাকার কারণে যুক্ত হয়েছিলেন!
ফলে সমাজতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতা এই দুটো প্রশ্নে জাতি বিবাদমান হয়ে পড়লো দুই বিবাদমান গ্রুপে! আওয়ামী এবং জাতিয়তাবাদী গ্রুপে! সংগত কারণেই উগ্র মৌলবাদী মহল সম্পর্কিত হলো জাতীয়তাবাদী গ্রুপে আর সমাজতন্ত্রীরা কোনো উপায় না থাকায় কিছু ডাইরেক্ট কিছু ইনডাইরেক্টভাবে সম্পর্কিত হয়ে পড়লো আওয়ামীদের সঙ্গে! কাজেই দুই গ্রুপেই সমন্বিত আছে ‘জনগণ’-এর সিংহভাগ! তারপর থাকে সংখ্যালঘু, পাহাড়ি, উপজাতি প্রভৃতির মিলিত সংখ্যার ‘জনগণ’। সংখ্যালঘুদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদী মুসলমানরা পূর্বাপর সব সময়েই হিন্দু বিদ্বেষী এবং সেই মানসিকতায় ভারত বিদ্বেষী যে এটাও বোধ করি গলা ফাটিয়ে বলার অবকাশ রাখেনা! সেই হিন্দু সম্প্রদায় যেমন ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থনে, তেমনই থাকলো সঙ্গতভাবেই! কিন্তু তারপরও বিভক্ত ‘জনগণ’-এর এক বিশাল অংশ সমন্বিত হয়ে গেলো বিএনপিতে, সেই বাস্তবতা থেকে চোখ ফেরানোর অবকাশ নেই। এই অংশের নেতা এবং বুদ্ধিজীবিরা খুব সহজেই অল্প সময়কালের মধ্যেই জনগণকে ভারতবিরোধী অবস্থানে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেন মূলত: ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়েই। তাদের উগ্র ধর্মবাদী চিন্তা চেতনায় মূর্তি পুজা এবং পূজকের দেশ ভারত তাই কিছু জনগণের মগজে এলার্জি হয়ে দাঁড়াল।
এই উগ্রবাদকে আগে থেকেই উস্কে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছিলো ভারত থেকে সম্পত্তি বিনিময় সূত্রে বাংলাদেশে আসা ভারতীয় মুসলমানের একটা বৃহৎ অংশ! এরাই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং উর্দুভাষী বিহারীদের মদদ যুগিয়েছিল রাজাকার আলবদর আল- শামস বাহিনী হয়ে! এই শ্রেণীর মুসলমানেরা পাকিস্তান আমলেই বিশেষত: ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অব্যাবহিত সময় থেকে বাংলাদেশে এসেই যোগ দিয়েছিল মুসলিম লীগের সাথে। হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং পরে বিএনপিতে সংগঠিত হয়েছে এদেরই বৃহৎ অংশ। এভাবেই এক উগ্র জাতীয়তাবাদী, ধর্মবাদী, হিন্দু বিদ্বেষবাদী, পাকিস্তানী চেতনায় প্রভাবিত অগণিত ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমন্বিত হয়েই গড়ে উঠেছিল বিএনপি! ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল শক্তিশালী! ফলে রাজনৈতিক কৌশল গণতন্ত্রের ছলনায় এরা ভোট যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী ও প্রগতিশীল অপরাপর দলগুলোর জোটকে। নৌকা, কুড়ে ঘর, কাস্তে হাতুড়ি ইত্যাদিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল ধানের শীষ আর পাল্লা।
আমার এই হালকা বিশ্লেষণী বিবরণ নেহায়েতই আমার একান্তই নিজস্ব পর্যবেক্ষণ এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ মাত্র। এর মধ্যে কোন নির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত হাজির করার তাই কোনো অবকাশ নেই। সাদামাটা এই চিন্তা থেকেই ধরে নেয়া যায় যে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যদি বিএনপি গং অংশ নিত তবে, তারা ভোটে জিততেও পারতো যে, তা বিস্ময়ের কিছু হতো না! এমনকী এখনো ভবিষ্যত নির্বাচনে তারা আওয়ামী খবরদারীমুক্ত সরকারের অধীনে ভোটের যুদ্ধে অংশ নিয়ে তাতে জয়যুক্তও হতে পারে, তাতেও বিষ্মিত হবার কিছু থাকবেনা! এমন প্রেক্ষাপটে পূনরায় যদি অবস্থা ৫ জানুয়ারি ধাচের কোন কৌশলে বর্তমান রাজনৈতিক ধারাতেই ধরে রাখা যায়, তবে তা কেমন হবে এটা ভাবা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
‘জনগণ’ এর একেবারেই বৃহত অংশটি স্পষ্টতই এখন মূল দুই ধারায় বিভক্ত। বিএনপি এবং আওয়ামী। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে একভাগে আছে ভারত-বিদ্বেষী, মৌলবাদী, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা থেকে দূরত্বে অবস্থানকারী (অবস্থাদৃষ্টে) এবং অন্য ভাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী, মুজিবীয় ইমেজ এবং প্রগতিশীল মহল। এর বাইরে ‘জনগণ’ এর ক্ষুদ্র একটা অংশ রয়েছে যেখানে সমন্বিত রয়েছ বাম গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট মহল। নির্বাচনে এই তৃতীয় শক্তি সম্পর্কে বিএনপি কখনোই আশাবাদী থাকেনি আদর্শগতভাবেই। কাজেই এরা সংগত কারণেই আওয়ামী ভাগে পড়ে যায়! তারপরও কিন্তু আওয়ামী জোট নির্বাচনী মাঠে নিরাপদ নয়! তদুপরি দুই দফা সরকারে থেকে এরা নানা কারণেই হয়ে পড়েছে বিতর্কিত! তাই এখন জাতির পক্ষে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এমন সিদ্ধান্তের জন্য যে নের্তৃত্ব প্রয়োজন তা আমাদের আছে কীনা সেটাই আশংকার বিষয়।
দল, মত এবং আদর্শের যে বিশ্লেষণ এখানে করা হলো তাতে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনও মসৃণ কাজ নয়! অথচ ঐক্যই জরুরী। সেই ঐক্যের আশায় পথ চেয়ে থাকা ভিন্ন আমাদের আর কীইবা করার আছে!
এবার প্রশ্ন, কী হবে যদি এই দুই গ্রুপের কোনোটিতেই কেউ কেউ ভোট না দেন? সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ‘জনগণ’ তৃধাবিভক্ত। আলোচ্য মূল দুই বৃহৎ গ্রুপ এবং তার বাইরের বাকি সকল! তবে এটা পরিষ্কার যে, তৃতীয় মতের জনগণ অধিকাংশই আওয়ামী ধারার বাক্সেই ভোট দেবেন, কিংবা বিরত থাকবেন। সেক্ষেত্রে যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তবে তারা স্ব-অবস্থানে থাকবেন, এখন যেমন আছেন! দেশ এখন অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে যে অবস্থায় আছে, সেভাবেই থাকবে! এর চাইতে খারাপ হবে না, বরং কিঞ্চিত আরেকটু ভালোও হয়তো হতে পারে। আর যদি সরলভাবে ভাবি যে বিএনপি নির্বাচনে এসে জয়লাভ করে সহযোগীদের নিয়ে সরকার গঠন করে, তবে? কিংবা যদি আবার পিছিয়ে গিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ক্ষেত্রে এভাবে ভাবি যে, তখনো এমন হতো যদি, তবে ইতোমধ্যে দেশের অবস্থা কোথায় থাকতো? আওয়ামী সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধীদের একে একে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, সেতু, ফ্লাইওভার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি উন্নয়ন যেগুলো হচ্ছে সেগুলো কী এতোটা হতো? দেশের মধ্যে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার যেটুকু চাষ হচ্ছে, তা আদৌ হতো কী? বর্তমান সরকার হেফাজতিদের উপদেশ নিচ্ছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক হচ্ছে, কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সরকারিকরণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে, ভারতের উপর ভরসা করছে, শেয়ার বাজার ধ্বংস করছে ইত্যাদি নেতিবাচক কাজগুলো বিএনপি থাকলে কী একেবারেই হতো না? যারা রাজাকারদের আদর করে পাকিস্তান থেকে আনিয়ে সরকারে মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত দিয়েছে, সেই তারা এতোদিনে আরো কোথায় যে নিয়ে যেতো দেশকে, এটা জেনেও তাদের অংশের সেই ‘জনগণ’ অপেক্ষা করছে ‘নিরপেক্ষ’, নির্দলীয় সরকারি তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের!
ইত্যকার বিশ্লেষণে কী মনে হয় যে অবস্থা ৫ জানুয়ারি পূর্বের অবস্থা থেকে উন্নত, সহায়ক, মসৃণ? আমি মনে করি মোটেই না! অথচ এটাও বুঝার বিষয় যে সংসদে কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে সেই সংসদীয় ‘গণতন্ত্র’ অনেকটাই অকার্যকর! তাহলে এ ধরনের একপেশে সংসদ নিয়ে অনেকটা অগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের এমন যাত্রা কী রাজনীতির ক্ষেত্রে সুখকর?
অবশ্যই না!
তাহলে?
জাতি তাই এখন সংকটে। এই সংকট মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যই একমাত্র সমাধান, নতুবা দেশ আরো গভীর সংকটেই নিপতিত হবে। উদার নৈতিকতার ভিত্তিতে এই ঐক্যের মূল শর্ত হোক অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মসহিষ্ণুতা, পরমতসহিষ্ণুতা, ন্যায় ববিচার, মানবতা এবং গণতন্ত্র।