উল্লাপাড়া শ্যমলীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে বাবাকে নিয়ে বাসে উঠলাম। তখনো যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু হয়নি। আমাদের নগরবাড়ি হয়ে ফেরিতে আরিচা এসে ঢাকার পথ ধরতে হবে। বাসের একপাশে তিন সীট অন্যপাশে দুই সীট। আমি তিন সীটের টিকেট কিনেছি। এতো পথ বাবা বসে যেতে পারবেন না। প্রয়োজনে তিনি যেন আমার কোলে মাথা রেখে শুতে পারেন। এই জন্যে তিন সীট।
বাবাকে বিদায় জানাতে প্রায় শখানেক গ্রামবাসী আমাদের সঙ্গে এসেছে। তারা সবাই বাবার কাছে বিদায়ী দোয়া নিচ্ছে। আমি তখনো নিচে দাঁড়িয়ে মেঝো ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছি। কথা বলতে বলতে মেঝভাই আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন। এতোদিন বাবা কাছে ছিল তার মর্ম বুঝিনি। আজ মনে হচ্ছে সব ফাঁকা হয়ে গেল। এই সময় মমতাজ চাচা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, তোমার মতো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি জানি তোমার বাসায় ভাই খুব সুখে থাকবেন। এবং সে আর গ্রামে ফিরে আসবেন না। তোমাকে কথা দিতে হবে ভাইয়ের মুখ খানা যেন শেষবারের মতো আমরা দেখতে পারি। তার কবর যেন গ্রামেই হয়। কথা দাও। আমি কথা দিলাম। তারপর চাচা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমরা কিন্তু আশায় রইলাম।
নগরবাড়ি ঘাটে বাস ফেরিতে উঠলে আমি বাবাকে বললাম, বাবা, আমরা এখন ফেরিতে উঠেছি। আপনি কি একটু হাঁটা চলা করবেন? অনেকক্ষণ হলো একভাবে বসে আছেন। যাবেন? বললেন, চলো। আমি তাকে ধরে ফেরির দ্বিতীয় তলার যাত্রী আসনে নিয়ে বসালাম। যমুনার থৈ থৈ পানি আর বিস্তীর্ণ খোলা আকাশ দেখে বাবার চোখজোড়া শিশুর মতো চঞ্চল হয়ে উঠলো। বাবা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আমার মনটা বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আমি বাবাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি যদি আমার শহুরে বউ তাকে সহজ ভাবে গ্রহণ না করে? যদি বাবাকে অবজ্ঞা অবহেলা করে? আমি নিজে দেখেছি আমার শশুর বাড়ির লোকজন গ্রাম থেকে কেউ এলে খুব বিরক্ত হতো। সেটা যদি আমার বাবা ক্ষেত্রে ঘটে। এই অযাচিত ভাবনাটি আমাকে কাবু করে ফেলে। ব্যাপারটি বাবার দৃষ্টি এড়ায়নি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাজান কিছু ভাবছো? আমি সরল ভাবে বললাম, হ্যা বাবা। ভাবছি, আপনার বউমা যদি আপনাকে ঠিকমতো সেবা না করে?
বাবা হেসে বললেন, আমার কপালে যা লেখা আছে, সেটাতো তুমি আমি কেউ খণ্ডাতে পারবো না। বউমা পরের বাড়ির মেয়ে। সে সেবা না করলে আমার তাতে দুঃখ নাই। তুমি মাঝে মাঝে আমার পাশে একটু বসো। তাতেই চলবে।
এই সময় আমাকে চমকে দিয়ে বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন, বাজান, তুমি এতটা বদলে গেলে কিভাবে?
-মানে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
বাবা বললেন, তোমাকে কতো বকা ঝকা করেছি। কখনো একটু আদর সোহাগ করিনি তোমাকে। মনে আছে, একবার ঈদে তুমি নতুন সার্ট চেয়েছিলে। আমি রাগ করে তোমাকে অনেক গালাগাল করেছিলাম। বাড়ি থেকেও চলে যেতে বলেছিলাম। তুমি সারাদিন না খেয়ে কেঁদেছিলে। তুমি খাওনি জন্যে তোমার মাও না খেয়ে ছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, তাই শুনে আপনিও না খেয়েছিলেন। বাবার চোখ এবার ভিজে গেল। বললেন, সেই তুমি আমার শেষ জীবনের খুঁটি হবে আমি ভাবি নাই। আশে পাশের যাত্রীদের কথা বাবা ভুলে গেছেন। তিনি মোনাজাতের ভঙ্গিতে দুহাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে আল্লাহ, আমার ছেলেকে তুমি রহমত দান কর। তার বালা মছিবত তুমি দূর করে দিও।
বাসায় এলাম। আমার স্ত্রী শ্যামলী খুব সহজ ভাবে বাবাকে গ্রহণ করলো। কিছুদিনের মধ্যে বাবা পুরো দস্তুর সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনি একা একাই টয়লেটে যেতে পারেন।
আমি বাইরে থেকে এসে হাতমুখ ধুয়ে বাবার কাছে এসে বসি। গল্প করি। আমি তাকে উস্কে দিয়ে তার গল্প শুনি।
বাবা একদিন হঠাৎ আমাকে কাছে ডেকে বললেন, তোমাকে একটা কথা বলবো। কিন্তু মনে থাকে না। আমার ভেতরটা ঝলক দিয়ে ওঠে। এই হয়তো আমার স্ত্রীর নামে কোন নালিশ করবেন। আমার বুক কাঁপছিল। আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বললেন, বাজান, তুমি বউমাকে কখনো কটু কথা বলো না। বড় লক্ষ্মী মেয়ে। আমি মরার আগে তোমার এই সুখ দেখে যেতে পারছি, এতা যে আমার কত বড় আনন্দ তুমি বুঝবে না। তুমি একটা লক্ষ্মী বউ পেয়েছ। তুমি ভাগ্যবান। তাকে কখনো কষ্ট দেবে না। আমার কাছে ওয়াদা করো। আমি হতভম্বের মতো বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি কি ভেবেছি। আর বাবা কি বলছে। আনন্দে আমার চোখ ভিজে গেল। রাতে শ্যামলীর কাছে বললাম, তোমার সেবায় বাবা ভীষণ খুশি। বাবা খুশি আমিও খুশি। এতটাই খুশি হয়েছি, তুমি যদি ক্ষমার অযোগ্য কোন অপরাধ করো, এমন অপরাধ তোমাকে ত্যাগ করতে বাধ্য। তারপরও তোমাকে আমি ক্ষমা করে দেব। কারণ তোমার সেবায় বাবা ভীশণ খুশি।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর পরিবারে আমার গ্রহণ যোগ্যতা আমূল বদলে যায়। বাবা বাড়িতে না থাকলে আমি তখন পরিবারের প্রধান কর্তা। আমার হাঁকডাকে সবাই তটস্থ। যেই না বাইরের উঠোনে বাবার গলাখাকারি শোনা যায় অমনি সবাই যার যার মতো নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মহিলারা ঘোমটা টেনে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। সেদিন আমি উঠোনে টিপু সুলতান যাত্রাপালার অভিনয় করছিলাম। বাবা নিঃশব্দে কখন ঢুকে পড়েছেন আমরা কেউ খেয়াল করিনি। তার চোখ মুখ থমথমে। এই প্রথম তাকে গলাখাকারি ছাড়া বাড়িতে ঢুকতে দেখলাম। তিনি সোজা গিয়ে বড় ঘরের বারান্দায় পাতা চৌকিতে হতাশভাবে বসে পড়লেন। আমরা সবাই অবাক হয়ে যে যার মতো আড়ালে নানা কথা বলাবলি করছি। মা গিয়ে তাঁর পাশে বসলেন। ঘটনা জানতে চাইলেন। পরে মার কাছে আমরা জানতে পারলাম, আমার বড় দুইভাই যৌথ পরিবার ভেঙ্গে তারা আলাদা সংসার করবে। আমি মাকে কারণ জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, একসঙ্গেতো আমরা ভাল আছি। অনেক আনন্দে আছি। তারা আলাদা হবে কেন? মা কোন জবাব না দিয়ে আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। বিষয়টি আমার কাছে গুরুতর মনে হলো।
বিকেলে দেখলাম বাড়িতে বড়বোন এসেছে। সে বড়ভাইকে বোঝাচ্ছে। তাকে বলছে আলাদা না হতে। ভাই কার কথা মানছে না। সে আলাদা হবেই। আমি মাকে বললাম, বড়ভাই আলাদা হলে তাতে সমস্যা কি? তোমরা এতো ভেঙ্গে পড়ছ কেন? মা বললেন, চরায় যত জমি সব তোর বড় দুইভাইয়ের।
-কেন? সব তাদের কেন?
মা বললেন, তোর বাপ সব জমি তাদের নামে লিখে দিছে।
-কেন? আমি বিস্ময়ে জানতে চাইলাম।
মা বললেন। তোর বাপ তাদের খুব ভালোবাসতো। এই জন্যে চরার সমস্ত জমি তাদের নামে লিখে দিয়েছে।
-তারা কি সব জমি নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম। মা বললেন, হ্যা। তাইতো। সেই গরমেই তারা এমন করছে। আমি বললাম, জমিতো সব বাবা কিনেছে। মা বললেন, কিনলে কি হবে এখন সব তাদের নামে।
বড়বু প্রথমে অনুরোধের সুরে বড়ভাইকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। বললেন, ইসহাক মাত্র কলেজে পড়ছে। ও বিএটা পাস করুক। একটা চাকরি বাকরি পাক তারপর তুমি আলাদা সংসার করো। ভাই কোন কথা মানছে না। বড়বু ক্ষেপে গেলেন। কণ্ঠ তুলে বললেন, এতো বাহাদুরি তুমি কার দৌলতে দেখাচ্ছ? সব জমি বাবার কেনা। যদি জমিজমা তোমার নামে লিখে না দিত? কোথায় থাকতো তোমার বাহাদুরি? তুমি কি মনে করছ, তুমি আলাদা হলে বাজান খালে পড়বে? না। আমরা এখনো মরিনি। ওরকম দশটা বাপকে ভাত দিয়ে পালার সামর্থ্য আল্লাহ আমাকে দিছে। আজ তুমি যা করলে এর প্রতিফল তোমাকে ভোগ করতে হবে।
বড়বু ফিরে এসে বাবার হাত ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। বললেন, বাজান, আমি আপনাকে দেখবো। বাবা বড়বুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুমি এই নির্বোধ বাপকে দোয়া করো, তাতেই চলবে।
আত্মীয়স্বজন সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে বড়ভাই এবং মেঝভাই আলাদা হয়ে গেলেন। সম্পত্তির বেশিরভাগ অংশ ছিল বড়ভাইয়ের নামে আর বাকিঅংশ ছিল মেঝভাইয়ের নামে।
আমরা হঠাৎ করে খুব গরীব হয়ে গেলাম। সেই প্রথম আমরা আটার রুটি খেলাম। বাবা আটার রুটি খেতে পারতেন না। শুধু তার জন্যে ভাত রান্না করতেন মা। গ্রামে তখন গরীব মানুষেরা আটার রুটি খেত। আমরাও তাই খেতে লাগ্লাম। খেতে খুব কষ্ট হতো। তবু নিঃশব্দে খেয়ে উঠতাম।
সপ্তাহ খানেক পর থেকে আমি বাবার অন্য চেহারা দেখলাম। বুক দিয়ে পাহাড় ঠেলতে শুরু করলেন। মার নামে তিনটে জমি ছিল সেই জমিতে বাবা শেষ রাতে গিয়ে এক কামলার কাজ করে তারপর বাজারে যেতেন। বাজারে তাঁর ছোট একটি দোকান ছিল। সেখানে বেচা বিক্রি করে দুপুরে এসে চারটে খেয়ে আবার জমির কাজে যেতেন। আমি তার সঙ্গে গেলে তিনি খুব মিষ্টি কণ্ঠে বলতেন, তুমি বাড়িতে যাও। এ কাজ তোমার নয়। তোমার কাজ লেখাপড়া।
দিন ঘুরতে লাগলো। বাবা টাকা সঞ্চয় করে জমি কিনতে লাগলেন। আর বড়ভাই অভাবে পড়ে জমি বিক্রি করতে লাগলেন। বড়ভাইয়ের একটি জমি বাবা কিনলেন। সেই জমি রেজিস্ট্রি করতে রেজিস্ট্রি অফিসে বাবার সঙ্গে আমি গেলাম।
ফেরার পথে রিক্সায় বসে বাবা বললেন, এক জমি দুবার কিনলাম।
জমি বিক্রি করতে করতে বড়ভাই নিরুপায় হয়ে অবশেষে বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলেন। অনেক দর কষাকষির পর আমি সেই বাড়ি কিনে নিলাম। বাবা তখন ঢাকা আমার বাসায়। তাকে এসে বললে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে দুহাত তুলে মোনাজাত করে বললেন, আমার পুত্রের কাজ করেছ। আমার অনেক সাধের বাড়ি অন্য মানুষ সেখানে খুঁটি গাড়বে আমি জীবিত থেকে এটা সহ্য করতে পারতাম না। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি পারবে। তুমি মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করা কি যা তা কথা। তোমার জন্য আমার গর্ব হয়।
বাবার দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। তারমানে আমার মায়েরা তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেছেন, ব্যাপারটা এমন নয়। বাবার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর কিছুদিন পর গ্রামেরই একজন মহিলাকে বাবা বিয়ে করেন। একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিয়ে আমার সেই মা ইন্তেকাল করলে তারপর বাবা আমার মাকে বিয়ে করেন। আমার সেই মাও
বাবাকে একা রেখে না ফেরার দেশে চলে যান।
আমার প্রথম মা ছিলেন অত্যন্ত রূপসী। বাবার ভাষায় ভীষণ দর্শনধারী। সেটা বোঝা
যায় আমার বড়ভাই এবং বড় দুবোনকে দেখলে। বাবা বলতেন, তোমার বড় মায়ের গায়ের রঙ ছিল দুধে আলতা রঙ। বড় মা অসুস্থ হয়ে পরলে বাবা সব কাজ ফেলে বড় মায়ের পাশে থাকতেন। আফসোস করে বড় মা বলেছিলেন, আমি মারা গেলে আমার ছেলেটার কি হবে? ওতো বোকা-সোকা। তেমন চালাক চতুর না। কি করে খাবে ও? বাবা তাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, সেটা নিয়ে তুমি ভেব না। আমি এমন ব্যবস্থা করব যাতে ওর কোন সমস্যা না হয়। কিছুদিন পর আমার বড় মা মারা গেলেন।
দ্বিতীয় স্ত্রী একটি সন্তান জন্মদিয়ে কয়েকদিন পর ইন্তেকাল করলে বাবা সেই শিশু সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। অনেকের পরামর্শে তিনি দেরি না করে তাড়াতাড়ি বিয়ে করেন। এবং প্রথম স্ত্রীর ভাবনা দূর করতে তার সমস্ত সম্পত্তি বড় ছেলে এবং শিশু সন্তানকে লিখে দেন। সেই এতিম শিশু সন্তানকে আমার মা আদর সোহাগ দিয়ে বড় করেন।
আমার মা ছিলেন গরীব ঘরের মেয়ে। দেখতেও সুন্দর ছিল না। লেখাপড়া বলতে কোন রকমে নিজের নাম লিখতে পারতেন। বাবা তাকে সংসারের কাজের জন্য বিয়ে করেছিলেন। বউ হিসেবে খাঁ বাড়িতে তার তেমন মর্যাদা ছিল না। আমার বড় দুই চাচী যাদের আমরা বড়মা আর ছোটমা বলে ডাকতাম। তাঁরা আমার মাকে বাড়ির বউ হিসেবে এততুকু মর্যাদা দেননি। এই নিয়ে মা আমাকে দুঃখ করে বলতেন, আমি সংসারে এততুকু সুখ পাইনি। কেউ আমাকে একটু দাম দেয়নি। কামের বেটি মনে করতো। আমিতো তোর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি বাজান। তুই মন দিয়ে লেখাপড়া কর। তোর বাবা যখন তোকে বকে আমার বুক ফেটে কান্দন আসে। খুব খারাপ লাগে।
তুই এমন করলে আমি তাহলে কার আশায় দুনিয়ায় বাঁচবো? মা যখন এমন করে আমাকে বলতো তখন আমার ভীষণ কান্না পেত।
মা আমাকে দুঃখ করে বলতেন, পরিবারের কোন অনুষ্ঠানে তোর চাচীরা চেয়ারে বসে শুধু হুকুম করতো। আমি কামের বেটির মতো শুধু খাটতাম। আমি তাদের কাছে গেলে তারা আমাকে কখনো চেয়ারে বসতে দিত না। তারা চেয়ারে বসে আমাকে টুল এগিয়ে দিত।
আমার চাচীরা ছিলেন ধনী ঘরের শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ। সে তুলনায় আমার মায়ের বাবার বাড়িতে কিছুই ছিল না। তারা ছিল ভীষণ গরীব। মা যখন চাচীদের আচরণে নিরবে কাঁদতেন আমি সহ্য করতে পারতাম না। বলতাম, মা, তুমি দুঃখ করো না। আমি বড় হয়ে তোমার সব দুঃখ দূর করে দেব।
আমাদের সংসার যখন হাসি আনন্দে টই-টম্বুর তখন বড় ভাই সংসার ভিন্ন করলেন। সবাই ভাইয়ের সিদ্ধান্তে অবাক। সবারই এক কথা, তার মাথা থেকে এমন প্লান আসেনি। তাহলে কার বুদ্ধিতে সে এমন করলো? সবার সন্দেহের তীর ভাবীর দিকে। ভাবী ধনি পরিবারের বাপের একমাত্র মেয়ে। ভাইয়ের শশুর বাড়ি থেকে নানা ধরনের জিনিস পাঠাতো আমাদের বাড়িতে। ভাবী ভীষণ চতুর প্রকৃতির মহিলা ছিলেন। দারুণ অভিনয় করতে পারতেন। আর আমার বড় ভাই ছিলেন তার বিপরীত। এমন ভাব করতেন আমার ভাবী, যাতে কেউ তাকে সন্দেহ করতে না পারে। সবার সামনে ভাইকে তিনি নিষেধ করতেন সংসার পৃথক না করতে। ভাই কেলাসের মতো তার বকুনি হজম করতেন। সবাই ভাবীকে বিশ্বাস করলেও আমার মা-বাবা তাকে বিশ্বাস করতেন না।
বাবা বলতেন, সেই হলো নাটের গুরু। তারই যুক্তিতে আমজাদ এইভাবে আমাকে সাগরে ফেলে আলাদা সংসার করছে। বাবা শুধু বলতেন, উপরে একজন আছেন, সেই দেখবেন।
কিছুদিন পর ভাবী প্যারালাইজে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পরলেন। সেই সময় ভাই তার সঙ্গে অমানবিক আচরন করতেন। তাদের দাম্পত্য জীবন যে সুখের ছিল না ভাইয়ের আচরণ দেখে আমরা বুঝতে পারতাম। আমরা তখন অতিত ভুলে ভাবীর পাশে গিয়ে তাকে সেবা করতাম। বাবা গিয়ে তাকে দোয়া করতেন। এই সময় একদিন বড়ভাই আচমকা একজন মহিলাকে লাল শাড়ি পরিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলেন। বললেন, তিনি বিয়ে করেছেন। সে রাতে সারারাত কাঁদলেন বড়ভাবী। নতুন ভাবী সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার পর বড়ভাবীর দুঃখের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। তাকে ঠিকমতো খেতে দেওয়া হতো না। বাবা প্রায় মাকে বলতেন, যাও বড় বউকে চারটে খাওয়া দিয়ে এসো। আমরা আপত্তি করলে বাবা বলতেন, কারো দুঃসময়ে তাকে আঘাত করতে নেই। তাকে ভালবাসা দিতে হয়। আল্লাহ তাতে খুশি হয়।
আরও কিছুদিন রোগে শোকে ভুগে ভাবী ইন্তেকাল করলেন। ভাবী যেন যাওয়ার সময় সংসারের লক্ষ্মী সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। শুরু হলো ভাইয়ের অধঃপতন। জমি বিক্রি শুরু করলেন। অবশেষে নুতুন ভাবীর পরামর্শে শশুর বাড়িতে স্থায়ী হওয়ার ব্যবস্থা করলেন। বাড়ি বিক্রি করে দিলেন। সেখানে যাওয়ার পর ভাবী সমস্ত টাকা নিজের দখলে নিয়ে ভাইকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। অভাবে অনাহারে করুণ ভাবে তার মৃত্যু হলো। মৃত্যুর আগে পাগলের মতো শুধু প্রলাপ বকেছেন, আমি ভুল করেছি। আল্লাহ তুমি আমাকে মাফ করো। আমার মতো ভুল যেন আর কেউ না করে।
ঢাকায় আসার পর বাবার হজম নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। ঘন ঘন তাকে ধরে টয়লেটে নিয়ে যেতে হয়। আমি বাসায় না থাকলে সেই কাজটি আমার স্ত্রী শ্যামলীকে করতে হয়। পুত্রবধূ তাকে ধরে নিয়ে টয়লেটের কমোডে বসিয়ে দেবে তাতে বাবা ভীষণ বিব্রত হতেন। আমি বাসায় ফিরলে শ্যামলী আমাকে বাবার এই সমস্যার কথা বলল। আমি বাবার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কেমন বোধ করছেন বাবা? বাবা বললেন, শরীরে হজম শক্তি কমে গেছে। বারে বারে পায়খানায় যেতে হয়। ব্যাপারটা শরমের।
আমি বললাম, বাবা, কাছেই একজন এম বি বি এস ডাক্তার বসেন ওষুধের দোকানে, আমি তাকে ডেকে নিয়ে আসি। বাবা বাঁধা দিয়ে বললেন, এটা আমার পুরনো রোগ ডাক্তার কিছু করতে পারবে না। তুমি বরং বাবুলকে ডেকে নিয়ে এসো।
বাবুল হলো শ্যামলীর সেজভাই। অন্যন্ত ভদ্র অমায়িক। শশুর বাড়ির লোকদের সাথে একমাত্র বাবুলের সঙ্গেই আমার ভাল সম্পর্ক। বাকিরা আমাকে ভীষণ অপছন্দ করে। বাবুল পেশায় ডাক্তার। এম বি বি এস পাস করে ইন্টার্ন শেষ করেই বছর দুই সে উল্লাপাড়া পূর্ণিমাগাঁতি হাসপাতালে চাকরি করেছে। সেই সময় বাবার সঙ্গে তার পরিচয়। ছুটির দিনগুলোতে বাবুল গ্রামের গরীব মানুষদের চিকিৎসা করতো। তারপর সে আর্মির মেডিক্যাল কোরে জয়েন করে। কম সময়ে সে ক্যাপ্টেন পদে পদন্নোতি পায়। কিন্তু সে চাকরি তাকে বেঁধে রাখতে পারলো না। স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে কাজি আলাউদ্দিন রোডের বাসায় চেম্বার খুলে বসে। সকাল বিকেল তার চেম্বারে রুগীর লম্বা লাইন লেগে থাকতো।
বাবার কথায় আমি পরদিন বাবুলের চেম্বারে গেলাম। গিয়েতো আমার চক্ষু চড়ক গাছ। বিশাল লম্বা লাইন। আমি ভেতরে যেতে একজন মহিলা ঢাকার স্থানীয় ভাষায় খেকিয়ে উঠলেন। ‘এই যে বড় মিয়া লাইন ভাইঙ্গা ভিতরে হান্দায়া গেলেন কেলা?’ আমি তাকে বললাম, আমি রুগী না। ডাক্তার সাহেব আমার আত্মীয়, আমি তার সাথে দেখা করেই চলে যাব। অনেক কষ্টে আমি বাবুলের কাছে যেতে পারলাম। তারপর ঝড়ের বেগে আমার সমস্যার কথা বলে আমি বেরিয়ে এলাম।
পরদিন রাতে বাবুল এসে হাজির। বাবুলকে দেখে বাবার চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সব শুনে বাবুল বাবাকে বলল, আপনার কিছু হয়নি। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। খেলেই ভাল হয়ে যাবেন। তারপর আর অনেক কথা হলো।
আমি বাবুলকে বিদায় দিতে বাসা থেকে নিচে নামলাম। বাবুলের বোন ভাইয়ের জন্য অনেক পদের রান্না করেছে। কিন্তু বাবুলের খাওয়ার সময় নেই। সে আরও কয়েকজনের বাসায় যাবে। নিকট আত্মীয়দের বাসায় গিয়ে তাদের শারীরিক খোঁজ খবর এবং বিনে পয়সায় তাদের চিকিৎসা করাই ছিল তার ব্রত। এই জন্যে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে নিজেই চেম্বার খুলে বসেছে। ডাক্তার বাবুল হয়ে গেল আমাদের পারিবারিক ডাক্তার। তাকে পেয়ে বাবা আরও কিছু সমস্যার কথা বললেন। বিশেষ করে তার দৃষ্টি শক্তি ঝাপসা হয়ে গেছে, ভাল করে কাউকে চিনতে পারেন না, এই কথাটি জোর দিয়ে বললেন।
নিচে নেমে বাবুল আমাকে বলল, চাচার অনেক বয়স হয়েছে। ওষুধে তেমন কাজ হবে না। যতটা সাবধানে রাখতে পারেন তাতেই তিনি সুস্থ থাকবেন। আর বলল, ওনার চোখে ছানি পরেছে। ফার্মগেট ইসলামিয়া হাসপাতালে নিয়ে যান। ওখানে আকবর মিয়া নামে একজন ডাক্তার আছে। আমার বিশেষ পরিচিত। গিয়ে আমার কথা বলবেন।
বাবুলের ওষুধে বাবার ধন্বন্তরি কাজ হলো। কয়দিনের মাথায় বাবা পুরো সুস্থ হয়ে উঠলেন। তাকে আর ধরে ধরে টয়লেটে নিতে হয় না। তিনি একাই যেতে পারেন। একেই বোধহয় বলে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদুর।’ দিনা কয়েকপর তাকে ফার্মগেট ইসলামিয়া হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। প্রচুর রুগী। আমি ডাক্তার আকবর সাহেবকে খুঁজে বের করলাম। তাকে বাবুলের পরিচয় দিয়ে আমার সমস্যার কথা বলতে উনি নিজেই একটি টিকেট কিনে বাবার নাম লিখে একটি রুমে নিয়ে গেলেন। বেরিয়া এসে বললেন, ওনাকে দোতালায় নিয়ে যান। আজই ভর্তি করতে হবে।
দোতালায় আরও প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশজন রুগী আছে। বিকেলে বাবার ব্লাড ইউরিন পরীক্ষা করলো। বাবার রিপোর্ট দেখে ডাক্তার নিজেই অবাক। কোন রকম দোষ ত্রুটি ব্লাডে এবং ইউরিনে পাওয়া যায়নি। পরের দিন অপারেশন।
পরেরদিন আমি এবং শ্যামলী গিয়ে বাসে আছি। বাবাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে। আমরা অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার সময় কাটতে চায় না। নিচে নেমে চা খেতে গেলাম। কাছাকাছি একটি রাস্তায় উপর চা দোকানে চা খেলাম আমি এবং শ্যামলী। চা খেয়ে আর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে হাসপাতালে ফিরে এলাম। ততক্ষণে অপারেশনের রুগীদের বেডে নিয়ে এসেছে। রুমে ঢুকে আমরা হতবাক। রুগীরা আঃ উঃ মরে গেলাম। কে আছ বাঁচাও। এমন ভাবে কাতর ধ্বনি করছে। আমরা বাবার বেডের পাশে এসে দাঁড়ালাম। বাবা নিশ্চুপ পড়ে আছেন। অন্য রুগীরা যেখানে আহাজারি করছে বাবা সেখানে নিরব। অজানা আশংকায় আমার মনটা কেঁপে উঠলো। আমি বাবার শিয়রের কাছে গিয়ে ডাকলাম, বাবা। বাবা হাসি মুখে বললেন, বাজান আইছ? আমি অবাক হয়ে বললাম, বাবা আপনার কষ্ট হচ্ছে না?
বাবা বললেন, কষ্টতো হচ্ছে।
আমি বললাম, ওনারা যেভাবে আহাজারি করছে সে তুলনায় আপনি চুপচাপ।
তিনি বললেন, আহাজারি করে কি হবে? তাতে কি কষ্ট কমবে? মাড়ি চেপে কষ্ট ভুলতে চেষ্টা করছি।
কোন রুগীর বেডে বিছানা বালিশ নেই। খালি মাথায় চিত হয়ে শুয়ে আছে সবাই। বাবা বললেন, এভাবে শুয়ে থাকা ভীষণ কষ্ট। আমি ডাক্তার আকবরকে খুঁজে বের করলাম। তাকে এই সমস্যার কথা বলতেই, তিনি বললেন, এটাই নিয়ম। এভাবেই দুদিন থাকতে হবে।
আমি ফিরে এসে বাবাকে বললাম, ডাক্তার এভাবেই থাকতে বলেছেন। না হলে চোখের সমস্যা হবে। বাবার দুচোখে ব্যান্ডেজ দেখে আমি বললাম, বাবা আপনার দুচোখে ব্যান্ডেজ কেন? বাবা বললেন, আমার দুই চোখেরই ছানি কেটে দিয়েছে।
আমি অবাক হলাম, কয় কি? এক চোখ অপারেশনের যন্ত্রনায় রুগীদের ত্রাহি অবস্থা। আর কিনা পঁচাশি বছরের একজন বৃদ্ধকে একসঙ্গে দুচোখ অপারেশন করে দিয়েছে। অনেক রাত অবধি বাবার পাশে থেকে আমরা বাসায় ফিরে এলাম। বাসায় এসে কেবলই মনে হচ্ছিল বাবার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বাবাকে সারারাত এই কষ্ট ভোগ করতে হবে। সেই কথা ভেবে আমিও সারারাত গুমোতে পারলাম না।
সবই ঠিকঠাক চলছিল। গোল বাঁধল একদিন দুপুরে বাবার খাওয়ার সময়। আমার বাবা ভীষণ ঝাল খেতেন। সেটা না দেখলে কারো বিশ্বাস হবে না। বাবার কারণে আমাদেরও বেশি ঝাল খাওয়ার অভ্যেস হয়েছিল। ঝাল দিয়ে রান্না করা তরকারির উপর তিনি গুঁড়ো মরিচ ছিটিয়ে নিয়ে তারপর খেতেন। শুকনো মরিচ ভেঁজে পাটায় বেঁটে গুঁড়ো করে একটি কৌটায় ভরে বাবার কাছে দেওয়া হতো। বাবা খাওয়ার সময় মরিচের গুঁড়ো পাতের ভাতের চারদিকে ছিটিয়ে নিয়ে তরকারি দিয়ে মাখিয়ে খেতেন। একদিন দুপুরে বাবা খাচ্ছেন, শ্যামলী কাঁটা বেছে দিচ্ছে। বাবা দ্বিতীয়বার ভাত চাইলেন। শ্যামলী ভাত দিতে বাবা কৌটা থেকে মরিচের গুঁড়ো বের করে ভাতে ছিয়িয়ে নিচ্ছেন সেই সময় একজন কমবয়সী ডাক্তার, করছেন কি, করছেন কি বলে চেঁচিয়ে ছুটে এসে কৌটা কেড়ে নিলেন। বাবার চোখে তখনো ব্যান্ডেজ। তিনি হা মুখে তাকিয়ে রইলেন। এমন ঘটনার জন্য আমরাও প্রস্তুত ছিলাম না। তরুণ ডাক্তার এবার আমাকে আক্রমণ করে কথা বলতে শুরু করলেন, উনি বৃদ্ধ অশিক্ষিত মানুষ। আপনাকে দেখেতো অল্প কিছু লেখাপড়া জানেন বলে মনে হচ্ছে। আপনি কোন আক্কেলে এই ধরনের মরিচ তাকে খেতে দিচ্ছেন? একটা সাকসেসফুল অপারেশন এইভাবে শেষ করে দিচ্ছেন?
বাবা তাকে থামিয়ে বললেন, ডাক্তার সাহেব, আপনি অকারণে আমার ছেলেকে বকছেন। তার কোন দোষ নেই। এটা আমার পঞ্চাশ বছরের অভ্যাস। আমার কিছু হবে না।
কিন্তু ডাক্তার বাবার কথায় কান না দিয়ে আমাকে বকতেই লাগলেন। আমি খুব বিব্রত বোধ করছি। আমাকে মূর্খ বেকুব এই ধরনের বকাবাজি করেই যাচ্ছিলেন, তখন শ্যামলী বলল, আপনি কাকে কি বলছেন? আপনি চেনেন তাকে? সঙ্গে সঙ্গে বাবা ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, বউমা ডাক্তারকে আমার ছেলের পরিচয়টা দাও। তারপর নিজেই বললেন, আমার ছেলে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তারা যদি যুদ্ধ না করলে আজ আপনি ডাক্তারতো দুরের কথা এই হাসপাতালের দারোয়ানও হতে পারতেন না। আর আপনি সেই থেকে আমার ছেলেকে যা মুখে আসে বলে যাচ্ছেন। মাফ চান। আমার ছেলের হাত ধরে মাফ চান। বাবার উচ্চস্বরে কথা বলায় আমাদের ঘিরে অনেক মানুষ জমায়েত হয়েছে। তরুণ ডাক্তার কি ভাবলেন জানি না, তিনি সত্যি আমার হাত ধরে ক্ষমা চাইলেন।
আমি বাবাকে বললাম, বাবা উনি সরি বলেছেন, আপনি তাকে মাফ করে দিন। বাবা বললেন, মাফ করবো, আগে আমার মরিচের কৌটা ফিরে দিক। ডাক্তার আর কথা না বাড়িয়ে মরিচের কৌটা দিয়ে দ্রুত চলে গেলেন।
লেখালিখি করি, লোকজন বলে লেখক। এই লেখক স্বীকৃতি প্রথম পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। সে আমার পরম পাওয়া। বাবার স্বীকৃতির চেয়ে বড় কোন স্বীকৃতি আর হয় না। পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ পুরস্কারও বাবার স্বীকৃতির কাছে তুচ্ছ। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। হল থেকে পুলিশ আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে।
গ্রামের বাড়িতে এসে অলস সময় কাটাচ্ছি। দুপুরে খেয়ে বাইরের ঘরে ঘুমিয়েছি। বাইরের ঘরকে আমরা বলি কাচারি ঘর। আমি যে ঘরে ঘুমিয়েছি সেই ঘরের বৈশিষ্ট্য হলো ঘরের একদিকে বেড়া তিনদিক খোলা। ঘরের সামনে ঘন দুব্বাঘাস। বিকেলে বাড়ির মা চাচীরা ওখানে বসে গল্পগুজব করে।
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি পাশ ফিরে দেখি দুব্বা ঘাসে বসে বাবা দুজন অচেনা মানুষের সঙ্গে গল্প করছেন। আমি নিঃশব্দে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইলাম। আমাকে দেখে আগত একজন
জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে?
বাবা বললেন, আমার ছেলে।
উনি বললেন, আগে দেখি নাই। কোথায় থাকে?
বাবা বললেন, ঢাকা থাকে।
-কি করেন?
বাবা ঝটপট জবাব দিলেন, লেখক। পেপারে লেখে। রেডিওতে লেখে। বাবার এমন জবাবের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আনন্দে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। চঞ্চল হয়ে উঠলো শরীরের রক্ত। চোখ ভিজে আসতে লাগলো। বাবা যে আমার লেখালেখি সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন সেটাই আমার জানা ছিল না। বাবা আমাকে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর আমার কি চাই। জীবনের সব পাওয়া আমার হয়ে গেছে।
আমি আড় চোখে লক্ষ্য করলাম, আগত মানুষ দুজন ভীষণ কৌতূহল নিয়ে আমাকে দেখছে। বাবা কিন্তু থেমে নেই। তিনি বলে চলেছেন। আগত দুজনের একজন বললেন, আমি তাকে দেখেছি। সেতো মুক্তিযোদ্ধা। বাবা এবার জোর দিয়ে বললেন, এইতো, ছেলের আসল পরিচয় বলতে ভুলে গেছি। তুমি তাকে কোথায় দেখেছ?
লোকটি বললেন, বাজারে একজন রাজাকারকে ধরে বেঁধে রেখেছিল। তখন আপনার ছেলেকে আমি কাঁধে স্টেনগান নিয়ে ঘুরতে দেখেছি।
রাতে খেতে বসে মাকে বললাম, আমি যে লেখালিখি করি বাবা এতো কিছু জানলো কি ভাবে? মা বলল, সেতো তোমার লেখার কথা শুনলেই অস্থির হয়ে ওঠে। কার কাছে শুনেছে রেডিওতে তোমার নাটক হবে, কোনমতে এশার নামাজ শেষ করে অমনি ছুটল তোমার চাচার বাড়ি নাটক দেখতে।
-তোমার যেতে ইচ্ছে করেনি? আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম।
মা বলল, যেতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সেখানে গেলে তোমার চাচীরা আবার কি মনে করে তাই গেলাম না। বাজান, আবার কবে নাটক হবে?
বললাম, নাটকের আগে জানাবো। মা বলল, শুধু জানালে হবে না, আমাকে একটা রেডিও কিনে দিতে হবে। বললাম, দেব। তুমি বলেছ আর কোন কথা আছে? তুমি একদিকে আর সমস্ত পৃথিবী একদিকে। তুমি যে আমার মা।
খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, নাটক দেখে বাবা কি বলল?
সে এক তাজ্জব ব্যাপার। নাটক দেখে এসে তোমার বাবা থোম মেরে বসে রইলো। আমিতো ভাবলাম খারাপ কিছু হলো কিনা। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, থোম মাইরা আছেন ক্যা? কি হইছে? তোমার বাবা লম্বা করি শ্বাস ছেড়ে বলে, এমন ছেলেকে আমি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিছিলাম। সেই কথা মনে পড়ছে। আর কান্দন আসতেছে। কি করছিলাম আমি। লুকিয়ে তুমি তাকে খাইতে দিছিলা। আমি দেখে লাঠি নিয়া তাড়া করছিলাম। ছেলে আমার পাতের ভাত রেখে সেই যে পালিয়ে গেল আমি আর সোনার চান্দের মুখ দেখি না। ওকে তুমি বাড়িতে নিয়ে এসো। ওকে না দেখলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।
সময়টা ১৯৭০ সাল। সবে এস এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমি মামাতো ভাই সালাম ভাইয়ের রায়পুর বাসায় থাকি। একদিন রেজাল্ট হলো। আমরা চার বন্ধু গ্রাম থেকে একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। একমাত্র আমি সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করলাম। বাকি তিনজন অকৃতকার্য হলো। রেজাল্ট নিয়ে বাসায় ফিরেছি, সালাম ভাই বললেন, তোর মায়ের অসুখ, আজই তোকে বাড়ি যেতে হবে।
আমি মায়ের অসুখের কথা শুনে ছুটতে ছুটতে বাড়ি এলাম। এসে দেখি মা দিব্বি সুস্থ। আমাকে দেখে মা ছুটে এসে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বলল, তুমি পরীক্ষায় পাস করেছ। তোমার বাবা খুশিতে মসজিদে মিষ্টি বিতরণ করেছে।
আমার কাছে সব কিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। আমি চারপাশ তাকিয়ে বাবাকে খুঁজছিলাম। না পেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা বলল, হাটে পাট নিয়ে গেছে বেচতে।
-কেন?
-তোমাকে ফুলপ্যান্ট বানায়া দেবে। তুমি না এখন কলেজে পড়বা।
রাতে বাবার মুখোমুখি হলাম। কিছুক্ষণ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। এমন করে বাবা কখনো আমাকে আদর সোহাগ করেননি। তিনি যখন আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলেন তখন আমার চোখ দিয়ে স্রোতের ধারার মতো জল গড়াচ্ছিল। তিনি অনেকগুলো টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, তোমার পছন্দ মতো ফুলপ্যান্ট বানাইও। আমি চোখ মুছে বাবাকে সালাম করলাম। পরদিন শহরে গিয়ে ফুলপ্যান্ট তৈরি করে আনলাম। সেই আমার প্রথম ফুলপ্যান্ট পরা।
বাবা আমার বাসায় আসার পর আমার জীবন ধারার আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়।
এখানে সেখানে আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরতাম। বাবা আসার পর রাত ৮/৯ টার মধ্যে আমি বাসায় চলে আসি। এসে হাতমুখ ধুয়ে বাবার সামনে গিয়ে বসি। বসেই বাবার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতাম। আমি কিছু বলতাম না। আমি শুধু রেকর্ডে পিন দেওয়ার মতো বাবাকে উসকে দিতাম। আর রেকর্ড বাজার মতো বাবা গল্প বলে যেতেন। প্রায়ই শ্যামলী এসে আমার সঙ্গে শ্রোতার আসনে বসে পড়তো।
অসম্ভব সুন্দর গল্প বলতেন আমার বাবা। তার বাচন ভঙ্গি, বলার ধরন, সর্বোপরি তাঁর মিষ্টি কণ্ঠ শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখতো। চমৎকার গল্প বলতেন বাবা। গল্পের মাঝে তিনি উদাহারণ হিসেবে কবিতা বলতেন। আবার কখনো সংস্কৃত শ্লোক বলে তার বাংলা মানে করে দিতেন। তাতে গল্প আরও হৃদয় গ্রাহী হয়ে উঠত।
ছোটবেলায় দেখেছি বাবার কয়েকজন ভক্ত এশার নামাজ শেষ করেই আমাদের বারিতে চলে আসতেন। বারান্দায় বসে পান খেতে খেতে তারা গল্প শুনতেন। এদের মধ্যে শমসের ফুফা ছিলেন নিয়মিত শ্রোতা। গ্রামের লোকজন তাকে ডাকতেন শমসের ফকির বলে। বাউল স্বভাবের মানুষটি দোতারা বাজিয়ে গান করতেন। বাবাকেও শোনাতেন। ঘরে শুয়ে আমরাও তাঁর গান শুনতাম।
সেই ছোটবেলায় বাবা মুখে শুনেছি রামায়নের কাহিনী, মহাভারতের কাহিনী, বিষাদসিন্ধুর কাহিনী।
বাবা এমনভাবে গল্প বলতেন আমি যেন দিব্য চোখে রাম লক্ষ্মণ হনুমানকে দেখতেন পেতাম। সীতাকে বিয়ে করার জন্য রাম যে চ্যালেঞ্জের জবাবে ধনুকে ছিলা পরিয়েছিলেন এবং ছিলা পরাতে গিয়ে ধনুক ভেঙ্গে ফেলেছিলেন, সেই কথা বাবা খুব জোর দিয়ে বলতেন। বাবা বলতেন, রাম ধনুকে ছিলা পরাতে যেই ধনুক বাঁকা করেছে অমনি মড় মড় শব্দে ধনুক ভেঙ্গে গেল। মড়-মড় শব্দটা বাবা এমন ভাবে উচ্চারণ করতেন মনে হতো দৃশ্যটি আমাদের চোখের সামনে ঘটছে।
মহাভারতের কাহিনীতে বাবা অর্জুনের পক্ষে ছিলেন না। তিনি পঞ্চপাণ্ডবের বড় পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের ভক্ত ছিলেন। মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথি ছিল ভগবান কৃষ্ণ। যুদ্ধে কৃষ্ণ অনেক ছলচাতুরি করেছে এইটা বাবার পছন্দ ছিল না। মহাভারতের দ্রপদি পাঁচ স্বামীকে নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন এই গল্পটি বাবা কখনো বলেননি। কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। হতে পারে বিষয়টি তাঁর ভাল লাগেনি।
বিষাদসিন্ধুর কাহিনী বলতে তিনি হোসেনের [রাঃ] বীরত্ব এবং ত্যাগের কথা বলে কেঁদে ফেলতেন। বিষাদসিন্ধুর বিয়োগান্তক কাহিনী শুনে আমরাও নিঃশব্দে কাঁদতাম।
সেদিন বাবার পাশে বসে আমি গল্পের সূত্র ধরিয়ে দিতে বাবা আমাকে থামিয়ে বললেন, বাজান, মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি ভুল বাবা?
বাবা বললেন, তুমি এতো বড় একটি কাজ করে এলে, কোনদিন তোমাকে ডেকে সেই গল্প আমার শোনা হয়নি। কাজটা ঠিক হয়নি বাজান। কিভাবে যুদ্ধে গেলে, কোথায় ট্রেনিং নিলে, কিভাবে যুদ্ধ করলে, বিপদ-আপদ হয়েছে কিনা সেটা কি জানা আমার দরকার ছিল না?
আমি হেসে বললাম, হয়তো ছিল। তার জন্যে সময়তো শেষ হয়ে যাচ্ছে না। বাবা বাঁধা দিয়ে বললেন, আমার সময়তো বেশি বাকি নেই বাজান। যে করদিন আছি শুধু তোমার যুদ্ধের কাহিনী শুনবো। বলো। বউমা আর সোহাগীকে ডাকো। সোহাগী আমার বড় কন্যা। ওর নাম অমৃতা খান। বাবা ডাকতেন সোহাগী বলে। বাবাই ওদের ডেকে কাছে বসাতেন। তারপর আমাকে বলতেন, বাজান শুরু করো। ওদের বলতেন, তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোন, ভবিষ্যতে এই কাহিনী হবে তোমাদের গর্বের বিষয়। বাজান শুরু করো।
আমি বলতে শুরু করলাম। একরাতে আমরা আশ্রয়ের জন্য একটি গ্রামে যাচ্ছিলাম।
আমরা প্রায় দুইশ মুক্তিযোদ্ধা। গ্রামে ঢুকতে প্রথমেই পড়ে একটি ভাঙ্গাচোরা বাড়ি। আমরা বাড়িটির কাছাকাছি যেতে একজন লোকের সঙ্গে দেখা। সে বদনা হাতে পাটক্ষেতে ঢুকছিল। বাড়িতে পায়খানার ব্যবস্থা নেই। পাটক্ষেতই তাদের ভরসা। আমাদের দেখে লোকটির হাত থেকে বদনা পড়ে যায়। ভয়ে কাঁপতে থাকে। এইবার আমার কন্যা হা হা করে হেসে ওঠে। ওর হাসি দেখে বাবাও হেসে ওঠেন।
তারপর আমাদের কমান্ডার অভয় দিয়ে লোকটিকে বলেন, ভয় নেই। আমরা রাজাকার না। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। কমান্ডারের অভয়বাণী শুনে লোকটির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কমান্ডার হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেন, আপনার হাগা কি গেছেগা?
লোকটি বলেন, জি, গেছে। আমার কন্যা আবার হেসে ওঠে। বাবা হেসে বলেন, ভয়ে তাঁর পায়খানা উপরে চলে গেছে।
আমাদের কমান্ডার জিজ্ঞেস করেন, এই গাঁয়ে রাজাকার কোথায় কোথায় আছে? লোকটি ত্বরিত জবাব দেন, আমগো গাঁয়ে কোন রাজাকার নাই।
কমান্ডার বললেন, আজ রাতে আমরা এই গাঁয়ে থাকব। কোন কোন বাড়িতে থাকলে ভাল হয় আপনি দেখিয়ে দেবেন। যা বলার আমরা বলবো। আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আপনি ফাঁকে থাকবেন।
সেটাই ঠিক হলো। লোকটি আগে আগে গিয়ে বাড়ি দেখিয়ে দেয়। কমান্ডার কয়েকজনকে নিয়ে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে আসেন।
এইভাবে মোটামুটি সবারই ব্যবস্থা হলো। বাকি থাকলাম কমান্ডারসহ আমরা দশজনের একটি দল। লোকটি বললেন, চলেন, আমার বাড়ির কাছে আমার চাচাতো ভাইয়ের বাড়ি। অবস্থা ভাল। ওখানে চলেন। কমান্ডার তাকে থামিয়ে বললেন, আপনার বাড়িতে চলেন। আমরা আপনার বাড়িতে থাকবো। লোকটি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, আমার বাড়িতে কিভাবে থাকবেন? আমার বাড়িতে থাকার মতো কোন ঘর নেই। কমান্ডার বললেন, আপনারা যেখানে থাকেন আমরাও সেখানেই থাকবো।
লোকটি আর কোন কথা না বলে আগে আগে রওনা দিলেন। তার বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। কমান্ডার বললেন, আজ রাতে আপনার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আপনি রান্নাঘরে থাকবেন। এই ঘরে আমরা থাকবো।
ঘরটি ভাঙাচোরা। ঘরে আসবাব বলতে মাত্র একটি চৌকি। আমি কমান্ডারকে বললাম, এখানে কিভাবে থাকবেন ওস্তাদ? কমান্ডার নিচু গলায় বললেন, বাধ্য হয়ে থাকতে হবে। এবং লোকটিকে নজরে রাখতে হবে। একমাত্র ওই জানে আমাদের যোদ্ধারা কোন কোন বাড়িতে আছে। যদি বেঈমানি করে ধরিয়ে দেয়? কাউকে বিশ্বাস আছে?
আমরা আর কথা বাড়ালাম না। এটাও যুদ্ধের একটা কৌশল। সে রাত খুব কষ্টে কাটলো। মেঝেতে লুঙ্গি বিছিয়ে মাথার নিচে ব্যাগ দিয়ে শুয়ে কোনভাবে রাত পার করলাম। ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছি। বেলা বারটা নাগাদ লোকটি আমাদের ডেকে তুললেন। বললেন, রাতে কিছু খান নাই। আমার বউ রান্না করছে। উঠে হাতমুখ ধুয়ে খান।
আমরা ঘরের মধ্যে কোণার দিকে গিয়ে মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। আমার পাশে কমান্ডার। খাওয়ার অনেক আয়োজন। মুরগির মাংশ, মাছ, ডাল, ভর্তা-এতো সব দেখে কমান্ডার রাগত বললেন, এতো সব কোথায় পেলেন?
লোকটি মাথা নিচু করে বসে থাকে। কথা বলে না। কমান্ডার ধমকিয়ে ওঠেন, কথা বলছেন না কেন? এতো সব কোথায় পেয়েছেন? না বললে আমরা কেউ খাব না। লোকটি মাথা নামিয়ে বললেন, আমার ভাইয়ের বাড়ি থেকে ধার করে আনছি।
-কেন। ধার করেছেন? শোধ দেবেন কিভাবে? কমান্ডার আবার ধমকে ওঠেন। বলেন, কতো ধার করেছেন? খাওয়ার পর ওই টাকা আপনি নিয়ে নেবেন। তাহলে আমরা খাবো।
লোকটি এবার কেঁদে ফেললেন। বললেন। আপনারা দেশের জন্য যুদ্ধ করতাছেন। আমরা কিছুই করতে পারতাছি না। লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, দেশটাতো আমারও। আপনারা দেশের জন্য জীবন বাজী রাইখা যুদ্ধ করতাছেন, আমি কি আপনাদের এক বেলা খেতেও দিতে পারবো না? তাহলে এ জীবন রাইখা লাভ কি? ওই বন্দুক দিয়া গুলি কইরা আমারে মাইরা ফালান। বলেই লোকটি কাঁদতে লাগলেন। আমি তাকিয়ে দেখি কমান্ডারের চোখে পানি। তিনি চোখ মুছে কান্না চেপে বললেন, তোমরা সবাই খাও। এই কথা শুনে লোকটির মুখে যে প্রশান্তির হাসি দেখা গেল, যা কোটি টাকা দিয়েও কেনা যাবে না।
আমি খেয়াল করে দেখি, আমাদের সব মুক্তিযোদ্ধার চোখ ভেজা। আমিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
এই লোকগুলোর কি অপরিসীম ত্যাগ। কিন্তু আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি।
[চলবে…]